কৃতজ্ঞতা, ধৈর্য ও আল্লাহর ফায়সালার উপর সন্তুষ্টি

20

নেয়ামত পেয়ে শোকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, বিপদে ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহ তায়ালার ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা ঈমানের অন্যতম পরিচায়ক। আর শোকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা জানানোর উেেশাক্য হলো, কারও উপকার এবং সুন্দর আচরণের প্রতিদান স্বরূপ তার প্রশংসা করা এবং তার প্রতিও সুন্দর আচরণ করা। মানুষের শোকর তথা কৃতজ্ঞতার একমাত্র হকদার হলেন মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন। কারণ সৃষ্টির সকল নিয়ামতের মূল উৎস হলেন তিনিই, জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই তিনি আমাদেরকে অসংখ্য অনুগ্রহের মাধ্যমে ধন্য করছেন। এইসব নেয়ামতের জন্য তিনি আমাদেরকে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার এবং সেগুলোকে অস্বীকার না করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: “অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় করো, আমার সাথে কুফরী কোরো না।” [আল-বাকারা; ২ : ১৫২]
আল্লাহ তাআলার নেয়ামত ও অনুগ্রহের প্রতি সর্বাধিক শোকরগুজার এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশকরি ছিলেন আল্লাহ তাআলার চয়নকৃত নবী-রাসূলগণ আলাইহিমুস সালাম। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন: “নিশ্চয়, ইবরাহীম ছিলেন (একাই) এক উম্মত (একটি জাতির জীবন্ত প্রতীক), আল্লাহর একান্ত অনুগত ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার রবের নেয়ামতের শোকরকারী। তিনি তাকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১২০-১২১]
আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে পাকে আমাদের প্রতি তাঁর কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে শোকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, খুব অল্প সংখ্যক মানুষই তাঁর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করে থাকে। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন: “হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছি তা থেকে আহার করো এবং আল্লাহর শোকর করো যদি তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদতকারি হও।” [সূরা বাকারা; ২ : ১৭২]
“আর অবশ্যই আমি তো তোমাদেরকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।” [সূরা আরাফ; ৭ : ১০]
“আর তাঁর নির্দেশনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি [বৃষ্টির] সুসংবাদ বহনকারী হিসেবে বাতাস প্রেরণ করেন এবং যাতে তিনি তোমাদেরকে তাঁর রহমত আস্বাদন করান এবং যাতে তাঁর নির্দেশে নৌযানগুলো চলাচল করে, আর যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ থেকে কিছু সন্ধান করতে পারো। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” [সূরা রুম; ৩০: ৪৬]
বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহর সমস্ত নেয়ামতের তালিকা করা অসম্ভব। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামতের গণনা করো, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অতিমাত্রায় যালিম, অকৃতজ্ঞ।” [সূরা ইবরাহীম;১৪: ৩৪]
আমরা আল্লাহর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করলে তিনি আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতিকে ক্ষমা করে দেন এবং আমাদের প্রতি করুনা করেন। তিনি এরশাদ করেন: “আর যদি তোমরা আল্লাহর নেয়মত গণনা করো, তবে তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবেনা। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১৮]
হযরত মু‘আয ইবনু জাবাল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত ধরে বললেন:“হে মু‘আয! আল্লাহ কসম, তোমাকে আমি ভালবাসি, আল্লাহ কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তারপর তিনি বললেন, “হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেক সালাতের শেষে তুমি বলতে ভুলে যাবে না: হে আল্লাহ্! তোমাকে উত্তমরূপে স্মরণ করার, তোমার শোকরিয়া করার এবং তোমার ইবাদত করার জন্য আমাকে সাহায্য করো তথা তৌফিক দান করো।” [আবু দাউদ- ১৫২২]
আল্লাহ নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করলে, আমরা তাঁর পক্ষ থেকে আরও বেশী নেয়ামত প্রাপ্ত হবো। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শোকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের (প্রতি আমার নেয়ামত) বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।” [ইবরাহীম; ১৪: ৭]
কৃতজ্ঞতা বা শোকরিয়া প্রকাশ বিভিন্নভাবে হতে পারে যেমন,অন্তরের শোকরিয়া, লিসান বা মুখের শোকরিয়া এবং অন্য সকল শারীরিক ক্ষমতার শোকরিয়া। “অন্তরের শোকরিয়া হলো আত্মসমর্পণ এবং বিনম্রতায়; লিসানের শোকরিয়া হলো প্রশংসা এবং স্বীকারোক্তিতে; আর শারীরিক ক্ষমতার শোকরিয়া হলো আনুগত্য এবং বশ্যতায়।” [মাদারিজ আল-সালিকীন ২/২৪৬]
শেখ সা‘দি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন: “মানুষকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে। তবেই সে পরিপূর্ণভাবে তাওহীদ-কে অর্জন করবে। যে কেউ মুখে বা অন্তরে আল্লাহর নেয়ামতসমূহকে অস্বীকার করবে, সে একজন অকৃতজ্ঞ এবং ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।”
তাই ঈমানের মূল কথাই হলো আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা যা তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: বান্দার প্রতি আল্লাহর সমস্ত নেয়ামতকে অন্তরে স্বীকার করা এবং সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা; আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা এবং এই শোকরিয়াকে কাজে লাগিয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত এবং আনুগত্য করা যিনি সমস্ত নেয়ামতের যোগানদাতা।” [আল-কাওল আস্-সাদীদ ফী মাকাসিদুত তাওহীদ পৃষ্ঠা ১৪০]
যারা তাঁর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করে না, তারা কোন ধরনের মানুষ, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “তারা আল্লাহর নেয়ামত চেনার পরও তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশই কাফির।” [সূরা নাহল; ১৬ : ৮৩]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান: “আল্লাহ্ সেই ব্যক্তির প্রতি খুশি হন, যে কোনো খাবার খাওয়ার পরে তাঁর প্রশংসা করে অথবা যে কোনো কিছু পান করার পর তাঁর প্রশংসা করে।” [সহীহ্ মুসলিম-২৭৩৪]
নেয়ামত সংখ্যা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার জন্য শোকরিয়া আদায় করাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলা’র সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় যা জান্নাতের অধিবাসীদের সবচেয়ে মহান বৈশিষ্ট্য। যখন জান্নাতীরা বলবে, “আপনি আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা সৃষ্টির মধ্যে অন্য কাউকে দেননি” তখন আল্লাহ্ তাআলা তাদের উদ্দেশে বলবেন: “আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়েও অধিক উত্তম কিছু দেবো না?” তারা বলবে “সেটা কী? আপনি কি আমাদের মুখমÐলগুলোকে উজ্জ্বল করেননি এবং আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি বা রক্ষা করেননি? তিনি বলবেন, “তোমাদের প্রতি আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম এবং এরপর আর কখনোও তোমাদের প্রতি রাগান্বিত হবো না।” (বুখারী, হা-৬০৯৪)
এ কারনে সালাফে ছালেহীন কেরাম বলেছেন: কেউ কোনো নেয়ামতের কথা গোপন করলে সে ওই নেয়ামতকে অস্বীকার করল, আর কোনো নেয়ামতের কথা প্রকাশ করলে সে ওটার জন্য শোকরিয়া আদায় করলো।
“আল্লাহ্ যখন কোনো ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন, তিনি ওই বান্দার উপর সেই অনুগ্রহের প্রভাব দেখতে ভালোবাসেন।” [মাদারিজি আল সালেকিন ২/২৪৬]
ওমর ইবনু আব্দুল আযীয রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন: আল্লাহর নেয়ামতের কথা পরস্পরকে স্মরণ করিয়ে দাও। কারণ সেগুলো আলোচনা করাও শোকরিয়া আদায় করা। (আশ শোকর: ইমাম ইবনু আবীদ দুনয়া, হা-২৭)
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত: “আল্লাহর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামাজ আদায় করতেন, তিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা মুবারক ফুলে যেতো। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বললেন: হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এমনটি কেন করছেন? অথচ আল্লাহ্ আপনাকে অতীতে ও ভবিষ্যতে কোন প্রকার গুনাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেননি। তিনি বললেন: “হে আয়েশা! আমি কি শোকর গুজারি বান্দা হবো না?” [বুখারি -৪৫১৩, ৪৫৫৭ এবং মুসলিম -২৮২০]

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ