কুমারী পূজা তাৎপর্য

49

 

স্ত্রী জাতির অন্তর্নিহিত দৈবী শক্তিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে মনু বলেছিলেন-
‘যে গৃহে সদা পূজা পায় নারীগণ
সে গৃহে দেবতা সুখে করে আগমন।’
ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিদের নারী প্রতীকে শক্তি সাধনার অনুবলে আমাদের এই পুণ্যভূমিতে সীতা, সাবিত্রী, দ্রৌপদী, দময়ন্তী, মৈত্রেয়ী, গার্গী, যশোদা, বিষ্ণুপ্রিয়া, অহল্যা, আন্দাল, মীরা এবং আরো অনেক অত্যুজ্জ্বল অরুণ বালা শুভ্র আলোর শঙ্খ রব করে গিয়েছিলেন। তাই নারী জাতির প্রতি আমাদেরকে সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে হবে। কারণ এই জগতে নারী মূর্তিতে দেবী দুর্গার সমধিক প্রকাশ। মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রী চন্ডী এই মহাসত্যই ঘোষণা করে- “স্ত্রিয়ঃ সমস্তা সকলা জগৎসু।” এই জগতে নারীতেই দেবীর অধিষ্ঠান। নারীদের যেভাবে দেখি না কেন, কুমারী, জননী, যুবতী, জায়া সকল নারীমাত্রই জগদম্বার জীবন্ত মূর্তি। নারীকে দেবী জ্ঞানে সম্মান করাই প্রকৃত মাতৃবন্দনা। প্রসঙ্গত বলতে হয়, দেবী দুর্গার আরেক নাম কুমারী। এজন্য শরৎকালের দুর্গাপূজার মহাষ্টমীতে আমরা জীবন্ত কুমারী পূজার মাধ্যমে তাঁর পূজা করে থাকি।
রাবণ বধের নিমিত্তে দেবীকে তুষ্ট করার জন্যে দেবগণ ও ব্রহ্মা দেবীর স্তব করেন। স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে দেবী মহামায়া কুমারী রূপে দেবতাদের দর্শন দিয়েছিলেন। এসময় তিনি দেবতাদের বলেছিলেন বিল্ল বৃক্ষতলে তাঁর বোধন করবার জন্যে। অতঃপর মর্ত্যে এসে ব্রহ্মা বিল্লবৃক্ষ শাখায় নিদ্রিতা অপরূপ বালিকার সাক্ষাৎ পান। ব্রহ্মার স্তবে তিনি উগ্রচÐায় রূপান্তরিত হন। এই কুমারী বালিকা দেবী চÐিকা। আর তাঁর অনুগ্রহে পুরুষোত্তম রামচন্দ্র রাবণ বধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই শরৎকালের দুর্গোৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে কুমারী পূজার প্রচলন আবহমান কাল থেকে। মহাষ্টমী পূজা শেষে এক থেকে ষোল বছরের (অঋতুবতী) কন্যাকে স্বয়ং পরমেশ্বরী রূপে পূজা করা হয়।
যোগিনীতন্ত্রে কুমারী পূজার প্রচলন সম্বন্ধে একটি বর্ণনা রয়েছে। ব্রহ্মশাপ প্রাপ্ত হয়ে ভগবান বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হয়। তিনি সেই পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে হিমাচলে মহাকালীর তপস্যা শুরু করেন। বিষ্ণুর তপস্যায় মহাকালী খুশি হন। দেবীর সন্তোষ মাত্রেই বিষ্ণুর হৃদপদ্ম হতে ‘কোলা’ নামক এক অসুরের জন্ম হয়। অতঃপর সেই কোলাসুর স্বর্গ থেকে ইন্দ্র সহ দেবতাদের বিতাড়িত করে বিশ্বব্রহ্মান্ড, বৈকুন্ঠ ও ব্রহ্মার কমলাসন দখল করে নেয়। তখন পরাজিত বিষ্ণু ও দেবতারা দেবীর স্তব শুরু করেন। অতঃপর স্তবে তুষ্ট দেবী দেবতাদের আশ্বস্ত করেন যে, তিনি অনতিবিলম্বে কুমারী রূপ ধারণ করে কোলানগরী যাবেন এবং কোলাসুরকে বধ করবেন। কালবিলম্ব না করে দেবী কুমারী বেশে এক অসহায় নারী রূপে কোলানগরী গমন করেন এবং অসুরাজ্যের নিকট খাদ্য প্রার্থনা করেন। কুমারী নারীর মিষ্টি কথায় কোলাসুর মুগ্ধ হলেন এবং তাঁর তৃপ্তি ও ইচ্ছামত খাবার প্রদানের জন্য অন্তঃপুরে তাকে নিয়ে গিয়ে নানারকম ভোজ্য দান করেন। মুহূর্তে দেবী সেই খাদ্য খেয়ে অতৃপ্ত বাসনা ব্যক্ত করলেন। তখন কোলাসুর দেবীকে যা খেলে তৃপ্তি লাভ হবে তাই খেতে বললেন। অসুরের কথা শুনে কুমারী আর দেরি না করে খাবার খেতে খেতে অবশেষে কোলাসুরকেও খেয়ে ফেললেন। দেবীর এই অদ্ভুত কার্যে দেবতারা মুগ্ধ হয়ে সকলেই তাঁর স্তব করতে লাগলেন। শুধু তা-ই নয় ব্রহ্মাÐতল নিবাসী সকলেই নিজ নিজ ঘরে কুমারী পূজোয় প্রবৃত্ত হলেন। যোগিনী তন্ত্র মতে, এভাবে ত্রিলোকে কুমারী পূজার প্রচলন হয়েছিল।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ দেবও সব নারীকে ভগবতীর অংশ বলেছেন। তিনি নিজ পত্নী সারদা দেবীকে ‘ষোড়শী’ রূপে পূজা করে জগতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সাগ্রহে সারদা দেবীকে সাধনার জপমালা অর্পণ করেছিলেন, কৃপা করেছিলেন নটি বিনোদিনী, গৌরিমা, গোপাল মাকেও। শুধু তা-ই নয় নারী জাতির প্রতি সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি তন্ত্রসাধিকা ভৈরবী ব্রাহ্মণীকে গুরুপদে বরণ করেছিলেন। ১৯০১ সালে বেলুড় মঠের প্রথম দুর্গাপূজায় স্বামী বিবেকানন্দ নয়জন কুমারীকে একত্রে পূজা করে নারীতে জগজ্জননীর রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বেলুড় মঠে পূজার শুরু থেকে আজ অবধি মহাষ্টমীতে পাঁচ থেকে সাত বছরের কুমারীকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। মহাভারতের দুর্গাস্ত্রোত্রে দেবীকে কুমারী জ্ঞানে বন্দনা করা হয়েছে-‘নমোহস্ত বরদে কৃষ্ণে কুমারী ব্রহ্মচারিণীঃ। এই কারণে কুমারী পূজা সনাতন ধর্ম দর্শনে সুগভীর তাৎপর্যব্যঞ্জক। শুধু দুর্গা পূজাতেই কুমারী পূজার প্রচলন তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে কোন কোন স্থানে কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, অন্নপূর্ণা পূজায় কুমারী নারীকে দেবীজ্ঞানে পূজা করতে দেখা যায়।
পরম প্রেমময় শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র ও তাঁর সত্যানুসরণ গ্রন্থে নারী জাতির প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা অবিচল রাখার কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায় “প্রত্যেকের মা-ই জগজ্জননী এবং প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্ন রূপ এমনতর ভাবতে হয়।” শ্রীশ্রী ঠাকুরও তাঁর মা মনমোহিনী দেবীকে গুরুপদে বরণ করে তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। মানুষের কল্যাণের জন্য যেসকল মহামানবেরা মানবদেহ ধারণ করে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁরা সকলেই নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান এবং মর্যাদা ও ভালোবাসার কথা বলেছেন।
আবহমান কাল থেকে প্রচলিত কুমারী পূজার শিক্ষাই হলো নারীদের প্রতি সম্মানবোধ অক্ষুন্ন রাখা এবং সমাজের তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধ সবার মাঝে নারীরা যে ভগবতীর অংশস্বরূপা এই বোধ জাগিয়ে তোলা। প্রত্যেক পূজা আমাদের সংযম শিক্ষা দিয়ে থাকে। কুমারী পূজাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পূজার মাধ্যমে মাতৃজাতির প্রতি সহিংসতা বহুলাংশে কমিয়ে দেবে, অমানুষদের মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত করবে এবং মানুষকে দেবতায় উন্নীত করতে সাহায্য করবে। সনাতন ধর্মদর্শনে সেই কারণেই কুমারী পূজার প্রবর্তন। অপরদিকে এই পূজার মাধ্যমে নারীরাও তাদের স্বীয় গৌরব অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করবে, যাতে করে তাদের আচার-আচরণ, চাল চলনে মাতৃভাব ফুটে ওঠে।
‘নারীতো রমণী নয় বিশ্বের জননী,
যুদ্ধে যাও বীরবর, এ মহাসত্য জানি।’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক