কুতুবুল আউলিয়া আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.) জীবন-দর্শন

36

 

মহান রাব্বুল আলামিন দুনিয়াবী আকাশকে যেমন সাজিয়েছেন অসংখ্য নক্ষত্রের মাধ্যমে তেমনি আধ্যাত্মিক আকাশকে সুশোভিত করেছেন তার প্রিয় বান্দা তথা গাউস, কুতুব, আবদাল, আওতাদ, নুক্বাবা, নুজাবা প্রমুখের মাধ্যমে। তাঁর সেই আধ্যাত্মিক আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন যুগশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল, পেশওয়ায়ে আহলে সুন্নাত হাফেজ ক্বারী আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি। আল্লামা হুজুর সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এমন এক বাতিঘর ছিলেন যে, যার রশ্মিতে আলোকিত হয়েছে সুদূর আফ্রিকা, বার্মা, বাংলা পাক-ভারতসহ এশিয়ার বিশাল এক ভূখÐ। তিনি ছিলেন বংশ পরম্পরায় ইমাম হোসাইন (রহ.)’র ৩৬ তম অধঃস্তন পুরুষ। ইসলামের জন্য নিবেদিত বীর পূর্ব-পুরুষদের ত্যাগের ঐতিহ্য বজায় রেখে তাঁর দীর্ঘ ১০৮ বছরের ইহজীবনের সবটুকুই উৎসর্গ করেছিলেন শরিয়ত-ত্বরিকতের বেমেসাল খেদমতে। তার প্রতিষ্ঠিত আন্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট এদেশের সুন্নি জনতার আশা-ভরসার জায়গা হিসেবে দেখা হয়। তিনি ছিলেন ইসলামের সমুজ্জ্বল বাতিঘর। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ময়দানে আন্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ওরশ মাহফিলে আল্লামা হুজুর সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলায়হির লক্ষ লক্ষ ভক্ত-অনুরক্ত শরীক হন এবং অশেষ পুণ্য হাসিল করেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : আঠারশ সালের ষাটের দশক ইংরেজ শাসিত এ উপমহাদেশে মুসলমানদের আজাদী আন্দোলনের এক ব্যর্থ অভিযান সিপাহী বিপবের স্মৃতি বহনকারী গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাল। নির্যাতিত, মুক্তিকামী অসহায় মুসলমানদের এমন এক দুঃসময়ে বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জেলার সিরিকোট শরীফের সুউচ্চ পাহাড় শীর্ষের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আপন আপন সময়ের ইসলাম-প্রচারক, খ্যাতনামা আউলিয়া-দরবেশ ছিলেন।
অনুসৃত পথ ও মত : আল্লামা হুজুর সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন শরীয়তের ক্ষেত্রে ইমাম আজম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হির হানাফী মাযহাবের অনুসারী। আক্বায়েদের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একান্ত অনুসারী ও নেতৃত্বদাতা। গাউসে দাঁওরা খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী-(রহ.) হাতে বায়আত গ্রহণ করে তিনি কাদেরিয়া ত্বরীকাভুক্ত হন এবং প্রধান খলিফার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কাদেরীয়া সিলাসিলার যে শাখাটি আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) কর্তৃক প্রচারিত হয় তা সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়া নামে পরিচিত লাভ করে।
শিক্ষা জীবন : আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) মাত্র বার বছর বয়সেই পরিপূর্ণ হাফেযে ক্বোরআন হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। হেফয শেষ করেই হুজুর শুরু করলেন দীর্ঘমেয়াদী মাদরাসা শিক্ষা জীবন। ইসলামী শিক্ষার এক একটি স্তর বা শ্রেণি অতিক্রম করতে করতে স্বদেশের মাদরাসা অঙ্গনের সর্বোচ্চ সনদ অর্জন করলেন। এতেও সন্তুষ্ট নন জ্ঞানপিপাসু আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.), এবার ছুটলেন জ্ঞানার্জনের জন্য দিল্লী শহরে। ভারতের বেশ কয়েকটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ক্বোরআন, হাদীস, উসূল, ফেক্বাহ্, তাফসীর, আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্জন শেষে সুদূর আফ্রিকা মহাদেশে রওয়ানা হয়ে যান।
আধ্যাত্মিক উন্নতি নিয়ে ভাবনা : এবার আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.)-ভাবতে লাগলেন নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির দিক নিয়ে। একদিন আল্লামা খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সাথে বসে আছেন আর মনে মনে ভাবছেন হুজুরের কাছে তো অনেক দিন কাটালাম। কিš‘ আধ্যাত্মিক উন্নতি তো এখনো হয়নি ? আর খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁকে লক্ষ করে নির্মাণাধীন মসজিদটি দেখিয়ে বললেন, দেখ! মসজিদকে বাহের চুনা লাগানে কাম হো রাহা হ্যায়, মগর আন্দর রাহ্ গেয়া। অর্থাৎ দেখ মসজিদের বাইরে (দেওয়ালে) চুনা লাগানোর কাজ চলছে ; কিš‘ মসজিদের ভিতরে এখনো কাজ বাকী রয়ে গেছে। তিনি বুঝে নিলেন যে, এ উদাহরণটি হুজুর তাঁর উদ্দেশ্যেই বলেছেন চৌহর শরীফের নির্মাণাধীন মসজিদটির ন্যায়ই তাঁর বাইরের শরীয়তী আমল ইত্যাদি ঠিক-ঠাক থাকলেও অন্তকরণ কাজ এখানো বাকী আছে। সুতরাং আত্মশুদ্ধির কঠিন রেয়াজত শুরু করে দিলেন। প্রবৃত্তির কু-প্ররোচনার ব্যাপারে আরো সতর্ক হলেন। নিজের পীরের প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আরো বাড়তে লাগলো।
দিন দিন রূহানী শক্তি বৃদ্ধি : যতই দিন যাচ্ছে আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) নিজের রূহানী তরক্কি উপলব্ধি করছেন। তিনি চৌহর শরীফ যাওয়ার পথে অনেক অলৌকিক ঘটনা দেখতে লাগলেন। যখন চৌহর শরীফের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে রওয়ানা হতেন রাস্তার দু-পাশের গাছপালা, পাথর তাকে সালাম জানাতো। পরপর দেখতেন চাঁদ-সূর্যও তাকে বলছেন আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) বলেন, আমি প্রথম প্রথম এসব কান্ড দেখে অভিভূত হয়ে যেতাম। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন মশগুল হয়ে গেলাম। কিন্তু পরে আমার চৈতন্যোদয় হলো যে, এসব নিয়ে বিভোর হওয়ার কি দরকার? শুরুতেই যেন রিয়া, ফখর, আমিত্ব স্থান পেয়ে না যায় এ ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেলেন আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.)-ছেড়ে দিলেন নিজের এসব আধ্যাত্মিক সুখবর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা।
আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শুধু মহানবী-(সা.) বংশধর ছিলেন তা নয় ; বরং আশিক-ই রাসূলও ছিলেন। তাই নবীদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী ও ইসলাম বিদ্বেষীদের ব্যাপারে ছিলেন আপোষহীন সিপাহশালার। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক। হিন্দু পরিচালিত কংগ্রেসের বিপক্ষে ছিল তাঁর কঠোর অবস্থান। সালফ-ই সালিহীনের অনুসৃত পথ ও মতকে ধারণ করে তিনি এ দেশে হানাফী মাযহাব ও সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠায় ছিলেন অগ্রনায়ক। তাঁর প্রতিটি কার্যকলাপে সুন্নাতই প্রকাশ পেত। শতবছরে উপনীত এ মহাপুরুষ কখনও ফরয ইবাদত ত্যাগ করেননি। তাঁর নিকটে থেকে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন ; তাঁদের মতে তাঁর নিদ্রাটাও ছিল সুন্নত উপায়ে। রাত্রের বেশীরভাগ সময় তিনি থাকতেন জাগ্রত। তাঁর মতে সুন্নাতের উপর অটল থাকা-ই প্রকৃত কারামত।
রেংগুনের উদ্দেশে মাতৃভূমি ত্যাগ : যুগে যুগে আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) মাতৃভূমি জাজিরাতুল আরব ছেড়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে সফর করেছেন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে একইভাবে দ্বীন ও ত্বরীকত প্রচারের উদ্দেশ্যে হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) পূর্বপুরুষগণও মাতৃভূমি মদীনায়ে মোনাওয়ারা ত্যাগ করে আফগানিস্তান হয়ে বর্তমানে পাকিস্তান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশস্থ সিরিকোট নামক স্থানে এসেছিলেন। তাঁরাও ছিলেন আওলাদে রসূল, আউলিয়া, গাউস, কুতুবগণ, যেমন, গরীবে নেওয়াজ খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, হযরত বায়েজিদ বোস্তামী, হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামেনী, হযরত শাহ্ মোহছেন আউলিয়া, হযরত শাহ বদর আউরিয়া, চট্টগ্রামের বার আউলিয়াসহ বেলায়তের অসংখ্য ধারক-বাহক এ উপমহাদেশে সুদূর মাতৃভূমি ছেড়ে এসেছিলেন, ঠিক সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল না আল্লামা হুজুর সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলায়হির জীবনেও। ফানাফিশ শায়খের প্রতিটি পরীক্ষায় সফলতার মাধ্যমে উচ্চ স্তরের বেলায়ত লাভে ধন্য হওয়ার পর সঙ্গত কারণে তিনি আর নিজ দেশে থাকতে পারলেন না। এ খোদায়ী শক্তি বেলায়ত দ্বীন ইসলাম ও ত্বরীকায়ে ক্বাদেরিয়ার কাজে লাগাতে হবে আল্লাহর হুকুম যেখানে হয়েছে সেখানে। তাই ১৯২০ সালে তাঁর পীর সাহেবের নির্দেশে সুদূর রেংগুনে চলে গেলেন। আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.)-যখন রেংগুনে চলে আসলেন তখন তাঁর বয়স ষাটের কম নয়। প্রৌড় বয়স সত্ত্বেও দ্বীন ও ত্বরীক্বতের সকল উদ্দেশ্য তাঁর মাধ্যমে সফল হয়েছিল ওই অঞ্চলে।
হুজুর সিরিকোটী (রহ.)-এবং তাঁর জীবন্ত কারামাত জামেয়া : আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.)-১৯২৫ সালে বার্মার রেংগুনে অবস্থানকালীন মাযহাব ও মিল্লাতের কর্মকান্ড পরিচালনার্থে আনজুমান-এ শুরায়ে রহমানিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.)-চট্টগ্রামে এসে এ সংগঠনকে পরিবর্ধিত করে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া নামে পুনঃপ্রতিষ্ঠিা করেন। যা আজ শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বে সুন্নী মুসলমানদের অন্যতম নির্ভরযোগ্য দ্বীনি কল্যাণ ট্রাস্ট হিসেবে স্বীকৃত। এ ট্রাস্টের মাধ্যমে অনেক মসজিদ-মাদরাসা, খানক্বাহ্, এতিমখানা নির্মিত ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। অধুনা এসব প্রতিষ্ঠান কেবল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শের ভিত্তিতে ধর্মীয় ও আধুনিক জ্ঞানাচর্চার কেন্দ্ররূপে সুপরিচিত। আল্লামা হুজুর সিরিকোটি-(রহ.)নিজ মুরীদদের উদ্দেশ্য করে বলেন ‘মুঝেহ্ দেখনা হ্যায় তো মাদরাসা কো দেখো, মুঝছে মুহাব্বত হ্যায় তো মাদরাসা কো মুহাব্বত করো। অর্থাৎ যদি আমাকে দেখতে চাও তবে মাদরাসাকে দেখ,আমার প্রতি মুহাব্বত থাকলে মাদরাসাকে মুহাব্বত করো। হুজুর কেবলার প্রেমিক ভক্তরা এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করছেন। জামেয়ার প্রতি মুহাব্বত সিরিকোটী রহমাতুল্লাহির প্রতি মুহাব্বতের নামান্তর। আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) এবং তাঁর জীবন্ত কারামাত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা।
ওফাত : ১৯৬১ সালের ১ শাওয়াল ঈদের জামাতে ইমামতির দায়িত্ব হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আল­ামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.) তাঁর সাহেবজাদার উপর অর্পিত বিশাল দ্বীনি নেতৃত্বের অভিষেক করান। ১ শাওয়াল থেকে ১০ যিলক্বদ পর্যন্ত এ চল্লিশ দিনে সাথে থাকতেন হুজুর আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি। প্রকৃতপক্ষে আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.), আল্লামা হুজুর তৈয়্যব শাহ্-(রহ.)’র হাতে গাউসিয়াতের মহান দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন এ চল্লিশ দিনে। এভাবে চল্লিশতম দিবসে লক্ষ লক্ষ ভক্ত অনুরক্ত মুরীদান অসংখ্য দ্বীনদার অনুসারীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে, এ উপমহাদেশের সিলসিলায়ে কাদেরিয়া আলীয়ার প্রবর্তক, শরীয়ত ও তরীকতের আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হাফেজ ক্বারী আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি-(রহ.)-১৯৬১ সালে ১০ যিলক্বদ ১৩৮০ হিজরীর রোজ বৃহস্পতিবার রাত বারোটায় শত বছরের কঠিন পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে সিরিকোট শরীফের রওযা মোবারকে চির বিশ্রামের জন্য এ জাহেরী হায়াতের ইতি টানেন এবং পরদিন ১১ যিলক্বদ জুমা দিবসে রওজা মোবারকে চিরশায়িত হন। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আল্লামা হুজুর সিরিকোটী-(রহ.)’র আদর্শ বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।
লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক