কী বার্তা দিল ডাকসুর ভোটের হিসাব?

47

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনের পর ফল বাতিলের দাবিতে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যান্য সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মধ্যেই নির্বাচনে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো যে ভোট পেয়েছে তা নিয়ে এখন চলছে নানা বিশ্লেষণ। নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে অন্য কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন নয়, বরং অরাজনৈতিক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
ডাকসুর শীর্ষ পদ ভিপি নির্বাচনেও জয়ী হয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া একজন প্রার্থী নুরুল হক নূর। বলা হচ্ছে, ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের দাবি এবং মনোভাব গুরুত্ব না পাওয়াতেই ডাকসুতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের সফলতার ইতিহাস এবার উল্টে গেছে। তাহলে ছাত্র রাজনীতিতে প্রচলিত ছাত্র সংগঠনগুলোর যে নিয়ন্ত্রণ এবার কি সেটা পাল্টে যাওয়ার পালা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে গিয়ে দেখা গেলো- জটলা পাকিয়ে আছেন জনা ত্রিশেক ছাত্রদল কর্মী। যদিও গত প্রায় দশ বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের এরকম প্রকাশ্য উপস্থিতি দেখা যায়নি। ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে মাসখানেক ধরে নিয়মিত ছাত্রদল কর্মীদের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনের পর ফল বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভও দেখিয়েছে সংগঠনটি। কিন্তু এবারের নির্বাচনের পূর্বে ২৮ বছর আগে যে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিলো, সেখানে নিরঙ্কুশ বিজয় পাওয়া ছাত্রদল এবারের নির্বাচনে কোন প্রতিদ্ব›িদ্বতাই গড়তে পারেনি। ভোট পাওয়ার হারও ছিলো একেবারেই নগণ্য।
ডাকসুতে শীর্ষ ৩টি পদে ছাত্রদলের প্রার্থীরা পেয়েছেন সর্বসাকুল্যে ১ হাজার এক ভোট। ছাত্রদলের বাইরে বাম সংগঠনগুলোর জোট পেয়েছে ২ হাজার ১শ ছয় ভোট। যেখানে ৩টি পদে জয়ী প্রার্থীদের ভোটের সংখ্যা প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার। কিন্তু ভোটের এই হিসাবকে প্রকৃত চিত্র বলে মনে করে না ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলো।
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার বলছিলেন, হলগুলোতে তো আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। কুয়েত মৈত্রী হলের যে কারচুপির চিত্র সেটা তো স্যাম্পল মাত্র। অন্যগুলোর কথা প্রকাশ্যে আসেনি। এই ফল তো বাস্তব না। একইরকম বক্তব্য বাম দলগুলোও দিচ্ছে। তবে এই বিষয়টিও অনেকে মানছেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে হয়তো অরাজনৈতিক প্রার্থীরাই আরো বেশি সফল হতেন।
ডাকসুর ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে ছাত্রলীগের তুলনায় অন্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর যেমন ভরাডুবি ঘটেছে, তেমনি এর বিপরীতে প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে উত্থান ঘটেছে কোটাবিরোধী আন্দোলন করে আলোচনায় আসা অরাজনৈতিক ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের। ভিপিসহ দুটি পদে জয়লাভও করেছে তারা।
অন্যদিকে ১৮টি হল সংসদের মধ্যে ৬টিতে শীর্ষ ভিপি পদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর মধ্যে দুটি হলে পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভের ঘটনাও আছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। তাহলে কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করলো? আর যদি সেটাই হয়, তাহলে এর কারণ কী?
ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম বলছিলেন, শিক্ষার্থীদের যে দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া সেগুলো ছাত্র সংগঠনগুলো ধারণ করবেন। এগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেন দরবার করবেন। এটাই তো হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ছাত্র নেতারা সেটা করেনি। গত দশ বছর কিংবা তার আগে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কাছে একরম জিম্মি ছিলো শিক্ষার্থীরা। নুরুল হক যে ভিপি হলো, সে তো শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা সংস্কার আন্দোলন করেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন রয়েছে সেগুলো জাতীয় পর্যায়ের কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সংগঠনগুলোর কার্যক্রমও চলে মূলতঃ রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে। ফলে শিক্ষার্থীদের না যতটা, তার চেয়ে বেশি মূল রাজনৈতিক দলের ইচ্ছাপূরণেই তৎপর হতে দেখা যায় ছাত্র সংগঠনগুলোকে।
এছাড়া বিশেষত গত ২৮ বছর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকার সময়ে মূলতঃ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোই নিয়ন্ত্রণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি। ছাত্রসংগঠনগুলোর এমন প্রবণতার মধ্যেই কোটা সংস্কারের মতো শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত কয়েকটি ইস্যুতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায় অরাজনৈতিক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাহলে প্রচলতি ছাত্র সংগঠনগুলোর হাতে দীর্ঘদিন ধরেই যে ছাত্র রাজনীতির এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ, এবারের নির্বাচনের ফল কী তাতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে? রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ তেমনটাই মেন করেন।
তিনি বলছিলেন, আগে যে ধরনের রাজনীতি ছিলো, এখন আর সেটা নেই। এখন হালুয়া-রুটির রাজনীতি শুরু হয়েছে। ছাত্র নেতারা শিক্ষার্থীদের কথা বলেন না, তারা করেন মূল দলের রাজনীতি। এটা তো শিক্ষার্থীরা চায় না।