কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প

360

পাশে এসে এমনভাবে দাঁড়ালো যেন আমরা একসাথে আছি। আমিও মনে মনে খুঁজছি। পাহাড়ের ওই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যদি আর একবার দেখা হতো। তাহলে সরাসরি বলতাম আমিও অস্ত্র হাতে পাকিস্তানিদের সাথে লড়বো। বেশ কিছুদিন থেকে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বাড়ার খবর প্রতিটি বাঙালি জানে। এক কান দুই কান করে সবার কাছে খবর চলে আসে। তাছাড়াও পাকিস্তানিদের বিভিন্ন স্থাপনার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবরও প্রতিদিন শোনা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সমানে গেরিলা আক্রমণ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন কিছুক্ষণ পর পর গোলাগুলির শব্দ কানে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে, চলে যাবার পর এই গোলাগুলি। পাকিস্তানি মিলিটারিদের দেখলে বুঝা যায় ওরা এই মুক্তির ভয়ে আতংকিত। উনার ইশারা পেয়ে এক সঙ্গে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে সিটি কলেজ পেরিয়ে চুনার গুদাম নামক জায়গায় এসে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক হালকাভাবে দেখলো। তারপর চুনার গুদামের ভেতরের রাস্তায় ঢুকে পড়লো। এই রাস্তার শেষ প্রান্তটি জঙ্গলে ভরা। মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে। জঙ্গলের ওই পাশটা রেলওয়ের পরিত্যক্ত মালামাল রাখার স্থান। নিরিবিলি এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ। এক সময় বন্ধুদের সাথে এসে ফড়িং ধরতাম। শত শত ফড়িং উড়ে বেড়াতো। আবার ছোট ছোট গাছে গিয়ে বসতো আমরা ফড়িংয়ের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হতো টেরও পেতাম না। এই জন্যে বাড়ির বড়দের কাছে অনেক বকুনি খেয়েছি। ফড়িং ছাড়াও আর একটা জিনিস করতাম। গাছ ভর্তি ছোট ছোট কাঁটা। ওই গাছে ছোট গোলাকার ফল ধরতো। লাল টক টকে। গাছ থেকে ছিঁড়ে মুখে পুড়তাম। ভেতরে ছোট দানাযুক্ত এই ফল মুখে দিলেই মিলে যেতো। সব বন্ধুরা এই ফল উৎসবের আমেজে খেতাম। যুদ্ধ শুরু হবার ক’দিন আগেও এখানে আসা হয়েছে। আর আজকে যাচ্ছি একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে। মনের মধ্যে এক অন্যরকম আনন্দ দোল খাচ্ছে। একসময় জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেলাম। মনে মনে ভাবতে থাকলাম। উনারা হয়তো সেই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা কদিন থেকে চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করছে। নিজেকেও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ভাবতে শুরু করলাম। আরও একটু ভেতরে ঢুকলাম। রেলওয়ের বিশাল সীমানা দেয়ালের তলদেশের মাটি সরিয়ে চলাচলের ছোট জায়গা করা হয়েছে। কোন অসুবিধা দেখলে এই জায়গা দিয়ে সরে পড়তে পারে।
ওখানে কয়েকজনের সাথে দেখা। তার মধ্যে দুজনকে চিনতে পারি। সেই পাহাড়ে দেখা। ওরা এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মেলালো। আমার ভেতরে এক ধরনের শিহরণ ঢেউ খেলে গেলো। নিজেকে অনেক বড় বড় ভাবতে থাকলাম। অন্যদেরও উৎসুখ আমাকে নিয়ে। তাঁদের সাথে আগে দেখা না মিললেও আমি এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালাম। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। সবার একই উদ্দেশ্য। মাতৃভূমিকে রক্ষা করা। এখানে বড়-ছোট ধর্ম বর্ণ কিছুই কাজ করে না। সবাই এক মন্ত্রে দীক্ষিত। একে একে সবাই বুকে জড়িয়ে ধরলো। জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট জায়গায় গোল করে বসলাম। দুইজন আড়াল থেকে পাহাড়াদার। অপরিচিত কেউ এদিকে আসছে কি না। অপরিচিত মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে চোখাচোখি করলেও এখন পুরোদমে আমাকে মেনে নিয়েছে। কোথাকার পিচ্ছি হারান এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বসে দেশ নিয়ে পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে একজন অমলদা নাম উচ্চারণ করতেই হারানের মাঝে তীব্র ইচ্ছে ভীর করে অমলদার সাথে থেকে কাজ করার। হারান বেশ কিছুদিন থেকে অমলদার নাম শুনে আসছে। লোক মুখে মুখে উনার নাম সব বাঙালিদের মুখস্ত, চট্টগ্রামে যতো গেরিলা আক্রমণ হয়েছে। সব আক্রমণ অমল মিত্রের নেতৃত্বে হয়েছে। হারানের কাছে অমল মিত্র একজন বীর পুরুষ। হারান এবার আড়চোখে অমল মিত্রের দিকে তাকালো। অমল মিত্রের মুখ ভর্তি দাঁড়ি। দেখে খুব শান্ত মনে হলো হারানের। এই শান্ত মানুষটা কতো ভয়ংকর রূপে পাকিস্তানিদের কাছে হাজির হয়। তা দেখে বুঝার উপায় নেই। হারান বেশ ক’বার তাঁর বীর পুরুষের মুখখানা দেখে। মাঝে মাঝে নিজেকে এক কাতারে নিয়ে স্বপ্নের জাল বোনে। এরই মধ্যে যুদ্ধ বিমানে শব্দ কানে আসতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। ভারতীয় যুদ্ধ বিমান। পাকিস্তানিদের ঘাটি লক্ষ্য করে বোমা মেরে আবার উড়ে যায়। বিমান লক্ষ্য করে পাকিস্তানির কামান দাগে। কামানের গোলা বিমান স্পর্শ করতে না পারলেই আকাশে সাদা সাদা দাগ সৃষ্টি করে। বিমান চলে যাওয়ার পরও কামান দাগার শব্দ কানে আসতে থাকে। চারটি বিমান দুই ভাগে উড়ে এসে কাজ সেরে আবার ফিরে যায়। ভারতীয় বিমান যখন আকাশে দেখা যায়। তখন হারানের মধ্যে জয় জয় ভাব আসে। এরই মধ্যে যতোবার বিমান আক্রমণ করেছে। বিমান ভূপাতিত করার কোন খবর হারানের কানে আসে না। আসে পাকিস্তানিদের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করার খবর। বিমান আক্রমণ করে ফিরে গেছে। পাকিস্তানিরা এখনো সাইরেন বাজিয়ে চলেছে। আমার কাজ আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো। আমি জঙ্গল থেকে বের হয়ে সামনের মাঠ কোনে প্রশ্রাব করার ভান করে বসে পড়ি। কেউ দেখলেও যেন ভাবেÑ আমি এই কাজ করার জন্য এখানে এসেছি। ফাঁকে ফাঁকে দেখতে থাকি- কেউ নজর দিচ্ছে কি না? ঘরে ঢুকতেই মার মুখোমুখি। মার চোখ আমার পায়ের আঙুলের ব্যান্ডেজের দিকে। মার প্রশ্নের আগেই বললামÑ হোঁচট খেয়েছি রক্ত বের হচ্ছিলো। তাই দোকান থেকে ঔষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে এসেছি। মা বিশ্বাস করলো কি না বুঝা গেল না। আমি স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করলাম। যদিও ব্যথা মাঝে মাঝে চিন চিন করছিলো। মাকে সত্য না বলার কারণ যদি মা ভয় পায়। সারাদিন হারানের উপর কতো যে ধকল গেছে কাউকে বুঝতে দেয় না। শীতের বেলা, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। হারান মাকে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে বলে। কিছুক্ষণ পর মা খাবার এনে হারানকে মাটিতে বসে খেতে দেয়। আজ হারান খুব তৃপ্তি নিয়ে খাবার শেষ করে। সারাদিন যে না খাওয়া সেদিকে খেয়াল ছিলো না। এবার হারানের চোখে ঘুম ঘুম ভাব। মা মাথার কাছে বসে মাথা বুলিয়ে দেয়। হারানের মনে হলো- যাই হোক না মাকে সব খুলে বলবে। বললো। মার চোখ টলোমল। হারান চোখ বোজে।
হারান খুব ভোরে উঠে দরজার ছিটকানিটা খুলে বাসা থেকে বের হয়। গতকালের নির্দেশ অনুযায়ী। বড় নালার উপর স্থাপিত ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে। নালাটি আইস ফ্যাক্টরী রোড উত্তর ও দক্ষিণ নালাপাড়ার উপর দিয়ে গেছে। এবং প্রত্যেক জায়গার নালার উপর পাকা ব্রিজ। পাকিস্তানি এক মেজরের গাড়ি আক্রমণ করে। এই নালার ভিতর দিয়ে কেউ উত্তর নালাপাড়া কেউ দক্ষিণ নালাপাড়ার ব্রিজ দিয়ে উঠবে। হারানের দায়িত্ব উত্তর নালাপাড়ার ব্রিজ। মুক্তিযোদ্ধারা যখন আক্রমণ করে এই নালা দিয়ে আসবে তখন ইশারা দিয়ে সিগন্যাল দেবে হারান।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর গোলাগুলি কানে আসে হারানের। হারান রাস্তার দুই দিকে বার বার তাকাচ্ছে মিলিটারির কোন গাড়ি আসছে কিনা। খানিক বাদে চারজনকে অস্ত্রসহ দৌড়ে আসতে দেখে। হারানের ইশারা পেয়ে দুইজন উঠে পড়ে রাস্তায়। বাকি দুইজন দক্ষিণ নালাপাড়ামুখী। সকালবেলা রাস্তাঘাট শুমশান। মানুষজনের আনাগোনা কম। হারান হাঁটতে থাকে সামনে। পিছে সদ্য যুদ্ধ করা দুইজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে মুক্তিযোদ্ধারা হারানের বাড়িতে গিয়ে উঠে। কিছুক্ষণ পর নালা দিয়ে মিলিটারিরা ফাঁকা গুলি করতে থাকে। এই নালায় গিয়ে মিশেছে কর্ণফুলি নদীতে।
এবার হারানের মার দায়িত্ব ও টেনশন বেড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কি খাওয়াবে। কি করবে। হারান বুঝতে পারে মা এর আগেও উনাদের জন্য, খাবার পাঠিয়েছিলো। মার খুব ইচ্ছে ওদের সঙ্গে গল্প করে জানতে। কিন্তু সদ্য যুদ্ধ করে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের টেনশনের পারদ এখন অনেক উঁচুতে। তারপরেও উনারা কান খাড়া করে বুঝতে চেষ্টা করছে। কেউ এই বাড়ির দিকে আসছে কিনা। বেলা বাড়ার সাথে খবর আসে মেজরসহ ৫জন মিলিটারির মৃত্যু। মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে। হারানের মা এই খবরটা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের দেয় তখন হারানসহ সবাই একে অপরের বুকে জড়িয়ে ধরে। যেন স্বাধীনতার গন্ধ আসতে শুরু করেছে।
এর ক’দিন পর রাস্তায় রাস্তায় মিছিল আর মিছিল। প্রকম্পিত কণ্ঠে শ্লোগান “জয় বাংলা”।