কিশোর গ্যাং কালচার বাড়ছে

51

মো: দিদারুল আলম

আমাদের সমাজে নতুন সংকটের নাম কিশোর গ্যাং! বিস্ময়কর হলেও সত্যি। যে কৈশোর দশ বছর থেকে শুরু হয়, সেই বয়স এখন আমাদের কাছে আতঙ্ক! পত্রিকার পাতা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গলির মোড় থেকে চায়ের দোকান, স্কুল কলেজের সামনে, গণপরিবহন জায়গায় ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচার’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িতদের বয়স হচ্ছে ১২-১৭ বছর। কিশোরদের সমস্যাটা আসলে কী? হঠাৎ করে ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচার’ নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে তাদের কর্মকান্ড?
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে। ছুটি গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।’ কৈশোরে ছেলেমেয়েদের আচরণ পরিবর্তিত হয়, তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয়, সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় খেই হারিয়ে ফেলছে সমাজের কিশোর ও তরুণেরা।
তারকাখ্যাতি, হিরোইজম, ক্ষমতা, বয়সের অপরিপক্বতা, অর্থলোভ, শিক্ষাব্যবস্থার ঝুঁকি এবং পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ায় তাদের সামাজিকীকরণ ও মানসিক বিকাশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে সমাজের বিভিন্ন গ্যাং কালচারের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে কিশোরেরা। যেখানে শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণের প্রথম ধাপ ছিল পরিবার কিন্তু আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সেখানে তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের স্যোশাল মিডিয়া।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে যেসব শিশু-কিশোরকে আমরা সুন্দর শৈশব ও কৈশোর দিতে পারিনি, যারা মা-–বাবার স্নেহ-ভালোবাসা এমনকি জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, তারা সহজেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় পেশাদার অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থে শিশুকিশোরদের ব্যবহার করে থাকে। পরবর্তীকালে এদের অনেকের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে উড়ালসড়কে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে যেসব শিশু-কিশোর ধরা পড়েছে, তাদের প্রায় সবারই জীবন ভাগ্যবিড়ম্বিত। সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশব বলতে যা বোঝায়, তা তারা পায়নি। এদের বেশিরভাগ বাস করছিল রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল বা ফুটপাতে। মূলত কিশোর গ্যাংই চট্টগ্রামের উড়ালসড়কে ছিনতাই করে থাকে।
ছিনতাই ও মাদক সেবন দুটোই গুরুতর অপরাধ। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত শিশু-কিশোরদের অপরাধী হিসেবে দেখা যাবে না। কোনটি অপরাধ আর কোনটি অপরাধ নয়, তা বোঝার বয়স তাদের হয়নি। সেক্ষেত্রে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু সমস্যা হলো, দেশে শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নামে যেকটি প্রতিষ্ঠান আছে, কোনোটিই মানসম্মত নয়। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবলও সেখানে নেই। যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, তাঁরা অনেক সময় শিশুকিশোরের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করে থাকেন। ফলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া জরুরি।
প্রতিটি কিশোর সংশোধনকেন্দ্রে উপযুক্ত বৃত্তিমূলক কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে এখান থেকে বেরিয়ে কাউকে অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে না হয়। প্রত্যেক শিশু-কিশোরের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কারও উপযুক্ত অভিভাবক না থাকলে রাষ্ট্রকে তার অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হবে। সব গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তা করে থাকে। উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠা বাংলাদেশ কেন সেই দায়িত্বটুকু পালন করবে না? রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক শিশুর সুন্দর শৈশব ও কিশোরের সুন্দর কৈশোরই তাকে অপরাধ থেকে মুক্ত করতে পারে।
কিশোর অপরাধ কমিয়ে নির্মূল করা সম্ভব। কিশোর গ্যাং থেকে ফিরিয়ে এনে কিশোরদের শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এরজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি আমাদের সদিচ্ছারও প্রয়োজন। ঘর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ সব জায়গায় কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে গান-নাচ-বাদ্যযন্ত্র শেখানো, আবৃত্তি, গল্প শোনা, গল্প বলা, গল্প বানানো, শব্দের খেলা, ছবি জোড়া দেওয়া, শারীরিক শিক্ষাসহ ধর্মীয় বিভিন্ন বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। প্রতিযোগিতা নয়, তারা কতটা সৃজনশীলভাবে তা শিখতে পেরেছে তা দেখা প্রয়োজন।
সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা মূলত পশ্চিমা রীতিনীতি অনুসরণ করেই তাদের কর্মকাÐ পরিচালনা করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আকাশ সংস্কৃতি, তথ্য প্রযুক্তির অবাধ অপব্যবহারসহ পরিবার তথা অভিভাবকদের ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব। কেউ কেউ বলছেন, যৌথ পরিবারগুলোর ভাঙ্গন শিশুদের বিপথগামী করে তোলার অন্যতম কারণ। অল্প বয়সে মোবাইল ফোনে আসক্তি, দেশি-বিদেশি টেলিভিশনে অপরাধ বিষয়ক নানা অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন শিশুদের অনেক সময় বিপথে টানতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশ হ্রাস পাওয়ার কারণেও সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে বলে মনে করেন অনেকে।
শিক্ষকদের হাত থেকে বেত তুলে নেয়ার পর থেকে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম বাড়ছে। আমাদের সময়ে কিশোর গ্যাং এত বেশি বেপরোয়া ছিল না। তখন শিক্ষকদের তারা খুব ভয় করতো। বেত তুলে দেয়ার পর থেকে তারা এখন শিক্ষকদের ভয় করে না বললেই চলে।
কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি কারণ তাদের ছেলেমেয়ে কার সাথে মিশছে, কিভাবে বড় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। পরিবারের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে কিশোরদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু কিশোরদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক