কিডনি-লিভার চক্রের শেকড়ের সন্ধানে র‌্যাব

28

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেসবুক পেজের সূত্র ধরে সদ্যবিদায়ী বছরের অক্টোবরের গোড়ার দিকে রাজধানী ঢাকা ও জয়পুরহাটে অভিযান চালিয়ে কিডনি কেনাবেচায় জড়িত একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব-২। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার নগরীর খুলশীর জাকির হোসেন রোডের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র এলাকায় অভিযান চালিয়ে একই কায়দায় কিডনি-লিভার ‘ডোনেশনের’ আড়ালে প্রতারণা ও মানবপাচার চক্রের আরেকটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৭। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে দুই চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এই চক্রের শেকড়ের সন্ধানে নেমেছেন।
র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ পূর্বদেশকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত পাচার চক্রের তিন সদস্যের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে এ ধরনের আরও চক্রের তৎপরতা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের হেফাজতে নিয়ে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা কিডনি ও লিভার ‘ডোনেশনের’ আড়ালে ভারতে মানবপাচার ও ভুক্তভোগীর সাথে প্রতারণায় জড়িত চক্রগুলোর শেকড়ের সন্ধানে নেমেছি। এ অপরাধে জড়িতদের মূলোৎপাটনে র‌্যাব অবশ্যই সফল হবে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, বিদায়ী বছরের শেষ দিকে প্রতারণার শিকার হওয়া কয়েকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ কিডনি ও লিভার ‘ডোনেশনের’ আড়ালে কেনাবেচা চক্রের তথ্য সংগ্রহে নামে। শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসা সেবা’ এবং ‘কিডনি লিভার চিকিৎসা সেবা’ নামে দুটি পেজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়। এ দুটি পেজের এডমিন ছিলেন কিডনি কেনাবেচা চক্রের অন্যতম হোতা মো. শাহরিয়ার ইমরান (৩৬)। তার বিরুদ্ধে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টিরও বেশি মামলা রয়েছে। গত বছরের ১২ অক্টোবর র‌্যাব-২ রাজধানী ঢাকা ও জয়পুরহাটে অভিযান চালিয়ে মো. শাহরিয়ার ইমরানসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। চক্রের অপর সদস্যরা হলেন, মো. মেহেদী হাসান (২৪), মো. সাইফুল ইসলাম (২৮),মো. আব্দুল মান্নান (৪৫) ও মো. তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু (৩৮)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য বিশেষ পাসপোর্ট ও ভিসা সম্পর্কিত বেশকিছু নথিপত্র, পাঁচটি মোবাইল ফোন ও দেশি-বিদেশি মুদ্রাও জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা র‌্যাবকে দেশে কিডনি কেনাবেচার নামে প্রতারণা ও মানবপাচারের জড়িত আরও কয়েকটি চক্র সম্পর্কে তথ্য দেয়। ওই তথ্যের সূত্র ধরে বিদায়ী বছরের ৩০ ডিসেম্বর র‌্যাব-৭ এর একটি দল নগরীর খুলশীর জাকির হোসেন রোডের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে একই কায়দায় কিডনি কেনাবেচার চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে মোহাম্মদ আলী ডালিম (৩৫), আতিকুর রহমান রনি (৩৬) ও মো. আলম হোসেন (৩৮) কে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে।
র‌্যাব কর্মকর্তাদের দাবি, হতদরিদ্র ও ধার-দেনাগ্রস্ত ব্যক্তিদের টার্গেট করেন তারা। এরপর সাড়ে চার লাখ টাকার বিনিময়ে কিডনি বিক্রিতে প্রলুব্ধ করা হয়। তাদের প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়া একজন কিডনি দাতার ভারতীয় ভিসা পাওয়ার কাজে ওই তিনজন জাকির হোসেন রোডের ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র এলাকায় গিয়েছিলেন। দেশে এ চক্রটির মূল হোতা ডালিম। আর ভারতে শাহীন নামে তাদের একজন সদস্য আছেন। রনি ও আলমের মাধ্যমে কিডনি ও লিভারের ‘দাতা’ সংগ্রহের কাজ করেন ডালিম ও শাহীন। তারা ভারতে অবস্থানরত রোগী বা স্বজনদের কাছ থেকে প্রতি দাতার অনুক‚লে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে দেশে যোগাযোগ করেন। প্রলোভনে পা দেয়া দাতাদের দেন দুই থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। কয়েকটি চক্র বিভক্ত হয়ে কিডনি কেনাবেচার এ কাজে জড়িত রয়েছে। ধরা পড়া দুই চক্রের সদস্যরা এ পর্যন্ত এভাবে শতাধিক মানুষের কিডনি দেশের বাইরে পাচার করেছে। চক্রের কয়েকজন সদস্য এর আগে কারাবাস করলেও মোটা অংকের টাকার লোভ সামলাতে না পেরে আবার ফিরে আসে পাচারের কারবারে। ডালিম-শাহীন চক্রের সদস্যরাও শাহরিয়ার ইমরানের মতই কিডনি ও লিভার দাতাদের উৎসাহিত করতে ফেসবুক পেজে প্রলোভন দেখায়। রাজি করানোর পর ওই ব্যক্তিকে পাসপোর্ট-ভিসার ব্যবস্থা করিয়ে দেন। বোনও দেশের ল্যাবে পরীক্ষা করে রোগীর সঙ্গে দাতার সবকিছু ম্যাচ করলে তাকে ভারতে পাচার করে। সেখানে যাওয়ার পর আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনও সমস্যা না পেলে তাদের কাছ থেকে কিডনি ও লিভার সংগ্রহ করেন তারা। এভাবে বাংলাদেশ থেকে চক্রটি অন্তত ৪০ জন লোককে কিডনি ও লিভার দাতা হিসেবে ভারতে পাচার করেছে। কিডনি বা লিভারদাতা ব্যক্তি পরবর্তীতে অসুস্থ হয়ে পড়লেও চক্রের সদস্যরা লাপাত্তা হয়ে যান।