কিডনি রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসা ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে

16

গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশও উদযাপন করেছে বিশ্ব কিডনি দিবস। এবার কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘সবার জন্য সুস্থ কিডনি’। বিষয়টি নিয়ে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালসহ ভুক্তভোগী রোগীদের গড়া বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এসব আয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। তবে কিডনি রোগের যেসব উপাদান রয়েছে তা মনুষ্যসৃষ্ট। যেমন বিভিন্ন ভেজাল খাবার, অতিমাত্রায় ব্যথানাশক ওষুধ সেবন, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন, মাদকাশক্তি, অনিয়ম ইত্যাদি।
এখানে কিছু বিষয়ের দায় ব্যক্তির অসচেতনতার উপর বর্তায়, আর কিছু বিষয়ে রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। ব্যক্তি ভেজাল প্রতিরোধ করতে পারবেনা, মাদক ব্যক্তি পর্যায়ে বন্ধ করা সম্ভব হলেও সামগ্রিকভাবে মাদক সেবন, উৎপাদন, পাচার, বিপণন বন্ধ করতে হবে সরকারকে। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়টি চিকিৎসকের উপর বর্তায়। এছাড়া আমাদের দেশে, সচরাচর প্রতিটি মানুষ নিজেদের চিকিৎসক ভাবতে ভালোবাসে। কোন মানুষ হঠাৎ কোনরকম অসুস্থতাবোধ করলে, জেনে বা না জেনেই পরামর্শ দিয়ে দিবে- ওই টেবলেটটি খেয়ে ফেলুন ভালো হয়ে যাবেন। সহজ-সরল মানুষ তাই করে। বিশেষ করে প্যারাসিটামলের মত টেবলেট যেকোন ব্যথায় গিলে খেতে ভুল করি না আমরা, অথচ এ একটি প্যারাসিটামলই কিডনির উপাদান সৃষ্টি করতে দেরি করে না। এ কথাগুলো একজন চিকিৎসক কিডনি সচেতনতামূলক একটি অনুষ্ঠানে গত বছর বলেছিলেন। আমরা ভারতে গিয়ে দেখতে পাই ওষুধের দোকানগুলো সহজেই প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি কনে না। কিন্তু আমাদের এখানে যত ওষুধের দোকানদার তত চিকিৎসক। এ বিষয়গুলো আমাদের খারাপ অভ্যাসে পরিনত হয়েছে, একান্ত সচেতনতার অভাব থেকে, কিংবা আলস্যজনিত কারণে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ঘরের পাশের ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ কিনে রোগ সরানোর প্রবণতা থেকেই কিডনি নষ্ট করার মত আত্মঘাতি কাজ আমরাই করছি প্রতিনিয়ত। কিডনিরোগে যারা ভুক্তভোগী তারা এবং তাদের পরিবার জানে এরোগের দুঃসহ যন্ত্রণা কি? এ রোগ একদিকে রোগীর জীবনকে ক্রমান্বয়ে বিপন্ন করে তোলে, অপরদিকে একটি পরিবারকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে, কিডনিরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সহজেই সুস্থ হন না, সৌভাগ্যবান হলে কিডনি ট্রান্সফার অথবা ডায়ালাইসিস করে কোনরকম জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে মাত্র। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে এ বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। কিডনি রোগ হওয়ার আগেই এর প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে হবে। নচেৎ দিনের পর দিন এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে। রোগীর সংখ্যাও বাড়বে।
কিডনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮০ শতাংশ বিকল না হওয়া পর্যন্ত কিডনি রোগের উপসর্গ বোঝা যায় না। ফলে বেশির ভাগ কিডনি রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন শেষ সময়ে। তখন রোগীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে ডায়ালাইসিস কিংবা কিডনি প্রতিস্থাপন। এতে বিপুল খরচ। এই ব্যয় বহন করতে না পেরে ৮০ শতাংশ রোগী চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিবছর মারা যান অন্তত ১০ হাজার রোগী। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, এক দশকে বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। ২০১২ সালে এই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৯৭৫। আর ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৭১। সঙ্গে বেড়েছে ডায়ালাইসিস করা রোগীর সংখ্যা। ২০১২ সালে ডায়ালাইসিস করান ২২ হাজার রোগী। ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬৭ হাজার ৬২০। অর্থাৎ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেছেন, ‘আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের কারণ সম্পর্কে যেটুকু জানা গেছে, তার মধ্যে কিডনির প্রদাহ ৪০%, ডায়াবেটিস ৩৪%, উচ্চরক্ত চাপ ১৫% এবং অন্যান্য ১১% (কিডনিতে পাথর, সিস্ট, মূত্রনালির প্রতিবন্ধকতা)। আকস্মিক কিডনি রোগের কারণ ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, আকস্মিক রক্তক্ষরণ, ইনফেকশন, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, আকস্মিক হৃদরোগ ইত্যাদি। এ রোগের একমাত্র ভরসা আগাম প্রতিরোধে সতর্ক থাকা, সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কিডনি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘কিডনি রোগ নির্ণয়ের জন্য এলবুস্টিক নামের একটি পরীক্ষা রয়েছে। এই পরীক্ষা দ্বারা তিনটি বিষয় জানা যায়, শরীরে গøুকোজের পরিমাণ, ইউরিনের পরিস্থিতি এবং রক্তচাপ।
বাংলাদেশে প্রতি ৬০০ জন রোগীর জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে যাঁরা চিকিৎসাসেবা দেন তাঁদের যদি শুধু এলভোস্টিক সাপ্লাই দেওয়া যায়, তবে মাত্র ১৫ টাকা খরচে এই পরীক্ষা করা যাবে। আর এতে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগী শনাক্ত করা যায়। এতে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কিডনি রোগী কমিয়ে আনা সম্ভব।’ আমরা মনে করি, কিডনিরোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। নি¤œ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের পক্ষে এরোগের ব্যয় নির্বাহ করা অসম্ভব প্রায়। দেশের বড় একটি জনসংখ্যা যাতে স্বল্পব্যয়ে চিকিৎসা করতে পারে সরকারকে সেই দিকে গভীর মনোযোগ দেয়া দরকার।