কিছু ওসি-ডিসি নিজেদের জমিদার মনে করে

60

হাইকোর্ট বলেছেন, কিছু কিছু ওসি-ডিসি নিজেদের জমিদার মনে করে। মনে হয় তারাই অল ইন অল। গতকাল মঙ্গলবার ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন শুনানিকালে বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যদিকে মোয়াজ্জেমের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. আহসান উল্লাহ ও সালমা সুলতানা। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. আব্বাস উদ্দিন।
শুনানিতে মোয়াজ্জেমের আইনজীবী মো. আহসান উল্লাহ আদালতকে বলেন, তার (মোয়াজ্জেম) মোবাইল থেকে ভিডিওটি এক সাংবাদিকের হাতে চলে গেছে। সেখান থেকেই ভিডিওটি ছড়িয়েছে। তখন আদালত বলেন, সাংবাদিকদের হাতে ভিডিওটি আগে গেলে তাকে (নুসরাত) মরতে হতো না।
মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, দেশে সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। ওই সাংবাদিক ওসির মোবাইল থেকে ভিডিওটি নিয়ে ছড়িয়েছে এবং তা স্বীকার করেছে। যে ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তার সাজার মাত্রা কম, অপরাধটি জামিনযোগ্য এবং তিনি অসুস্থ হওয়ার কারণে তার চিকিৎসা দরকার বলেই জামিন আবেদন করেছি। এছাড়া তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, তার পেনশনের একটা বিষয় রয়েছে। জামিন দিলে তো তিনি পালিয়ে যাবেন না।’
এ সময় আদালত বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি গুরুতর। সে অপরাধে সাজা বেশি না কম তা বড় কথা নয়। মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, তিনি বয়স্ক। কানে সমস্যা, কম শোনেন। আদালত তখন বলেন, তিনি কানে কম শুনলে ওসি থাকেন কী করে?
এরপর মোয়াজ্জেমের আইনজীবী মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের ব্যক্তিগত বিষয়ে মন্তব্য করলে আদালত বলেন, সাংবাদিকরা যদি শুরু থেকেই এ ঘটনার পেছনে লেগে থাকতো, তাহলে এ ঘটনা (নুসরাতের মৃত্যু) ঘটতো না। সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। ব্যারিস্টার সুমনও সমাজের দর্পণ। তখন মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, সরকারি চাকরি যারা করেন, তারাই জানেন তাদের কী কষ্ট! খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এরপর শুনানি করতে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, সরকারি অফিসার হয়ে তিনি (মোয়াজ্জেম) ভিডিও করলেন, তা ভাইরাল হলো। তাকে জামিন দিলে জনমনে কী মেসেজ যাবে? তিনি অসুস্থ থাকলে জেল অথরিটি রয়েছে, তারাই তাকে চিকিৎসা করাবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিজনারস সেলে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ আছে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ অফিসারদের এমন দায়িত্বহীন কাজ আগে দেখিনি। মেয়েটিকে যেসব প্রশ্ন করেছে তা শোনা যায় না (অশ্লীল ভাষা)! তখন আদালত বলেন, কিছু কিছু অফিসার নিজেদের জমিদার মনে করে, সবাই কিন্তু না। কিছু কিছু অফিসার এমন আছে। অনেক দেশেই এমন আছে, তবে আমাদের দেশে বেশি।
আদালত তখন বলেন, মেয়েটি থানায় অভিযোগ করতে এলো। এজাহারের জন্য তাকে (নুসরাত) লিখিত বক্তব্য দিতে বললেই হতো। সেখানে এসব প্রশ্নের কোনও দরকার হয়? ওসির প্রশ্নগুলোর কোনও প্রসঙ্গ দেখি না।
মাহবুবে আলম বলেন, এখানে কোন প্রেক্ষাপট কাজ করছে? এসব প্রশ্ন করে মজা করবে আবার ভাইরাল করবে? একেবারেই দায়িত্বহীনতার কাজ করেছে। আদালত বলেন, ঘটনা শুনে তার সহানুভূতি দেখানো উচিত ছিল। তখন যদি মেয়েটিকে নিরাপত্তা দেওয়া হতো তাহলে এ ঘটনা এতদূর এগোতো না।
এরপর আদালত মোয়াজ্জেমের জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন। এর ফলে মোয়াজ্জেমের কারামুক্তি মিলছে না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
প্রসঙ্গত, ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে তার মা ২৭ মার্চ থানায় অভিযোগ দাখিল করেন। এরপর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে থানায় ডেকে নিয়ে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন এবং তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন।
এরপর গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলায় তদন্ত শেষে ১৬ জনের বিরুদ্ধে ২৯ মে ফেনীর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পরই নুসরাতের জবানবন্দির (ওসির কাছে দেওয়া) বিষয়টি সকলের সামনে আসে। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে গত ১৫ এপ্রিল মামলা করেন।