কালের সাক্ষী মালকা বানু মসজিদ

110

সবুর শুভ

মালকা বানুর দেশেরে, বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজেরে/মালকা বানুর সাতও ভাই, অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই। মালকা বানুর বিয়া হইবো, মনু মিয়ার সাথে রে’ লোকগানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনু মিয়া ও মালকা বানুর জীবনগাঁথা। যেখানে আছে প্রেম আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক। আগেকার সময়ে ঐতিহ্য আর ইতিহাস একঘাটে জলখেলে গড়ে উঠত স্মরণীয় কিছু। মালকা বানু মসজিদ ওই ধরনেরই একটি স্মারক। যা যুগযুগ ধরে প্রতিনিধিত্ব করছে ঐতিহ্যের পালক হিসেবে। মালকা বানু চৌধুরী মসজিদ। মসজিদের পরতে পরতে আছে ঐতিহ্য, শৈল্পিক নৈপুণ্যতা ও স্থাপত্যশৈলি। সঙ্গে স্মৃতির স্মারক হয়ে আছে প্রেম, ভালবাসার। তাই মালকা বানু মসজিদটি ঐতিহ্য ও প্রেমের স্মারক হয়ে আছে সবার কাছে। কালের সাক্ষী হয়ে কালনিরবধি দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নে এটির অবস্থান। মালকা বানু চৌধুরীর জন্মস্থান বাঁশখালীর সরল ইউনিয়ন। এখানেই অবস্থিত মালকা বানু চৌধুরী মসজিদটি। মোগল শাসনামলের শেষ দিকে মালকা বানু চৌধুরীর পিতা জমিদার আমির মোহাম্মদ চৌধুরী মসজিদটি নির্মাণ করেন। এক সময় মসজিদের পূর্ব পাশেই ছিল বিশাল এক দীঘি। সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে দীঘিটা। এক চোখের পথই ছিল এই মালকা বানুর দীঘি। দীঘির পশ্চিম পাশে ঐতিহ্যের স্মারক স্বরূপ মালকা বানুর মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের দেওয়ালের পূর্ব পাশে ফরাসি ভাষায় খোদাইকৃত একটি শিলালিপি ছিল। সেখানে মালকা বানু চৌধুরী মসজিদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ ছিল। তবে ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে এটি হারিয়ে যায়। ফলে শত শত বছরের প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতিবহ মসজিদটির বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।
তথ্যমতে, মালকা বানুর পিতা আমির মোহাম্মদ চৌধুরী ছিলেন তৎকালের প্রভাবশালী জমিদার। তার আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা মালকা বানু চৌধুরী। তার বাবার জীবদ্দশায় মালকা বানু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন চট্টগ্রামের আনোয়ারার আরেক জমিদার পুত্র মনু মিয়ার সঙ্গে। মনু মিয়া একদিন পাইক-পেয়াদা (সঙ্গী-সাথী) সঙ্গে নিয়ে জমিদারি তদারকি করতে বাঁশখালীর সরল গ্রামের সওদাগর বাড়িতে পৌঁছে সাময়িক বিশ্রাম নেন। এ সময় মনু মিয়ার অপূর্ব সুন্দরী সওদাগর কন্যা মালকা বানুকে কাজীর মক্তবে অধ্যয়নরত অবস্থায় দেখতে পান। তখন থেকেই মালকা বানুর প্রেমে পড়েন মনু মিয়া। এরপর প্রেমের টানে মনু বারবার ছুটে যেতেন মালকা বানুর বাড়িতে। অবশেষে কাজীর মাধ্যমে মালকার বাবার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন মনু। মালকার বাবা সওদাগর রাজি হলেও মালকা বানু বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কারণ হিসেবে মালেকা মনুকে বলেছিলেন- সাম্পানযোগে নদী পার হতে তার ভয় করে। কারণ শঙ্খ নদীর এপারে মনু মিয়ার বাড়ি, ওপারে মালকার বাড়ি। তাই বধূ সেজে মনু মিয়ার বাড়ি যেতে হলে উত্তাল শঙ্খনদী পাড়ি দিতে হবে। মালকার মুখে এ কথা শুনে মনু মিয়া স্থির করলেন শঙ্খের বুকে বাঁধ নির্মাণ করবেন। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। মনু মিয়া শঙ্খ নদীর বুকে নির্মাণ করলেন বিশাল এক বাঁধ। তারপর বধূ সাজিয়ে সড়কপথে মনুর রাজপ্রাসাদে এনে তুললেন মালকাকে। জনশ্রতি আছে, মালকা বানু ও মনু মিয়ার বিয়ে হয়েছিল খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে। একমাস ধরে চলেছিল তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। তাদের সংসারে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তবে পরে মালকা বানু স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে পিতৃবাড়িতে চলে আসেন। সাত পুত্র সন্তান ও এক কন্যার জনক আমির মোহাম্মদের আদরের একমাত্র দুলারী মালকা বানুর স্মরণে বাঁশখালীর সরলে একটি মসজিদ ও দীঘি নির্মাণ করেন। যা ইতিহাসে মালকা বানুর মসজিদ ও দীঘি নামে পরিচিত। মালকা বানু মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান নিয়ে ইতিমধ্যে লোকগাঁথা, যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র নির্মিত হয়েছে। একদিকে প্রেম আরেকদিকে ঐতিহ্যের স্মারক। এই দুইয়ে মিলে স্মৃতি জাগরুক মালকা বানু মসজিদ এখনও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসেবে।