কামাল লোহানী

13

কামাল লোহানী, একজন বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের সংবাদ বেতারে তিনিই প্রথম পাঠ করেন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
কামাল লোহানী ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন তৎকালীন পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলা) সনতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী ও মাতা রোকেয়া খান লোহানী। তারা আসল নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। কামাল প্রথমে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা শুরু করেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।এরপর এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
কামাল লোহানী ছাত্রজীবনে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে জড়িত হন।১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজে নুরুল আমিন ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতাদের আগমনের বিরোদ্ধে শিক্ষার্থীদের এক প্রতিবাদী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক মঞ্চের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং অনেকের সাথে পুনরায় গ্রেফতার হন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে কারাবাস করেন। ১৯৫৫ সালের জুলাইতে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ঢাকা চলে আসেন এবং মার্ক্সবাদের সাথে জড়িত হন। এ সময় তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতি করতেন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের সময় অনেকর সাথে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২ সালেও কারাবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য ছিলেন।
কামাল লোহানী ঢাকায় আসার পর চাচাত ভাই ফজলে লোহানীর সহায়তায় ১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকার কর্মরত ছিলেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুদফায় যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নৃত্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বেশ কিছু দেশে অংশগ্রহণ করেন। এসময় তার নৃত্যগুরু ছিলেন জি এ মান্নান। মান্নানের প্রযোজনায় তিনি ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ নাট্যে অংশ নেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের উপর তৎকালীন পাকিস্তান করকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কামাল নিষেধাজ্ঞা উপক্ষো করে ছায়ানটের নেতৃত্বে জন্মশতবার্ষিকী পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রæয়ারি পল্টন ময়দানে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি ও উদ্বোধন করেন। এসময় তিনি ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’ নামক একটি গণসংগীত অনুষ্ঠান আয়োজন, ‘আলোর পথযাত্রী’ নামক একটি নাটক পরিচালনা ও এতে অভিনয় করেন। ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’ নামক একটি নৃত্যনাট্যে বিবেকের ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সাথে তিনি এ আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।
কামাল লোহানী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের সংবাদ বেতারে তিনিই প্রথম পাঠ করেন। বেতারে তিনি ঘোষণা করেন, “আমরা বিজয় অর্জন করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।” একই বছরের ২৫ ডিসেম্বর তাকে ঢাকা বেতারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী এবং ১৯৭২ সালের ফেব্রæয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতা সফর উপলক্ষে তৎকালীন দমদম বিমানবন্দরেও (বর্তমান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে দৈনিক জনপদ নামক একটি পত্রিকাতে যোগদানের মাধ্যমে পুনরায় সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে আসেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবার্তা, এরপর দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করে ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার নির্বাহী সম্পাদক ও ১৯৭৮ সালে সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধের ফলে দৈনিক বার্তা ছেড়ে দেন এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। ১৬ মাস মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর তিনি পুনরায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে চলে আসেন। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পুনরায় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নবনাট্য সংঘ নামে পদক্ষেপ ধর্মী নাট্য দল তৈরি করেন যা দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা ছিলেন।
কামাল লোহানী ব্যক্তিজীবনে ১৯৬০ সালে চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই কন্যা ও এক পুত্র রয়েছে। দীপ্তি ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্র অভিনেতা ফতেহ লোহানী এবং সাংবাদিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী তার চাচাত ভাই।
কামাল লোহানী ২০২০ সালের ২০ জুন ৮৭ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেণ। সূত্র : উইকিপিডিয়া