কাব্যময়তা ও গীতিময়তা প্রাসঙ্গিক ভাবনা

366

শাকিল আহমদ

(গত সংখ্যার পর)
কিন্তু পাঠক হৃদয়ে গভীর দাগ রেখে যেতে সক্ষম। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠত্ব বা বিশেষত্ব এখানে যে, অতি ক্ষুদ্র মানব জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ তাঁর মনস্তত্তে¡ গভীর রেখাপাত করে পাঠক হৃদয়কে করে আন্দোলিত। আর সেই কারণেই লিরিকের আর্টের মতো তার ছোটগল্পের আর্টেও একটি সহজাত সঙ্গতি খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস পাঠকসমাজে লক্ষণীয়। একটি ভাবকে উপজীব্য করে যে ভাবে লিরিক কবিতা পল্লবীত হয়ে উঠে; অনুরূপভাবে একটি আখ্যানকে বেষ্টন করেই ছোটগল্পের সমাপ্তি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় যা সহজেই অন্যের চোখে ধরা পড়ে না, এসব অবহেলিত বিষয়কে উপজীব্য করেই যেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের পটভ‚মি গড়ে ওঠে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে- এক অজপাড়াগাঁয়ে পোস্টমাস্টার কিভাবে রান্না করে খাবে তা যেনো রতনেরই এক চিন্তার কারণ। কিংবা ‘ছুটি’ গল্পে গ্রামের এক দুরন্ত বালক ফটিকের ফেলে আসা গ্রামকে ফিরে পাওয়ার ব্যাকুল আর্তনাদ, অথবা স্কুলের ছোট ছাত্রকে অত্যাচারী পন্ডিত মশাই কি নামে ডাকতেন, এই নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনে কারো মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে না। অথচ ইত্যেকার ছোট ছোট ঘটনাকে বেষ্টন করে হৃদয়ের যে ফল্গুধারার প্রবাহিত হয় তা রবীন্দ্র মানস্তত্তে¡ই অসাধারণ হয়ে ধরা পরে। আর এখানেই কাব্যময়তা উপস্থিতি থাকতে পারে, তবে গীতিময়তার আতিশয্যে খুব বেশি দোষারোপ করা চলে না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কিছু কিছু গল্পে প্রকৃতি ও মানব প্রেমকে অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কবির কল্পনা দিয়ে মানবপ্রেম ও প্রকৃতিকে যেমন একই সমান্তরালে দাঁড় করানোর চলে; তেমনি তার অনেক গল্পেও মানবজীবনকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে বিশালতায় উপনীত হতে দেখা যায়। হৈমন্তি ক্ষুদ্রপরিসরে আর দশটি সংসারের মত আবদ্ধ হলেও তার সংযোগ ছিল উন্মুক্ত- বিশাল প্রকৃতির সান্নিধ্যে। সুতরাং হিমালয়ের বিশালতা নিয়ে যেন তার মনোজগতের বিস্তার ও বেড়ে ওঠা। শুধুমাত্র একজন কবির কবিত্ব শক্তি দিয়েই যেন ‘হৈমন্তী’, ‘অতিথি’ ইত্যাকার গল্পগুলো প্রকৃতি ও মানব মনের এক বন্ধন রচনা করে। গল্পের মধ্যে এই যে কাব্যময়তার অনুপ্রবেশ তা নিঃসন্দেহে যে কোন গল্পের শিল্পশৈলীর বারতি সংযোজন।
ছোট গল্প লিখতে লিখতেই রবীন্দ্রনাথ তার একটি কাঠামো বা কলাকৌশল ও যেন নির্ধারণ করেছেন, তাঁর গল্পগুলির উৎস সম্পর্কেও তিনি বলেছেন-
“ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল,
অন্তরে অতৃপ্তি রবে,
সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হ’য়েও হইল না শেষ।”
রবীন্দ্রনাথের আঙ্গিক বা প্রকরণ এবং ভাষাগত দিক থেকে শত বছর পরে এসে খানিকটা পরিবর্তিত রূপ ও লক্ষণীয় বাংলা কথাসাহিত্যে। অবশ্য সাহিত্যের পরিবর্তনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও এভাবে চিন্তা করে গেছেন, সেই এক শতাব্দী আগে- ‘নদী যেমন বাঁক ফেরে সাহিত্য ও তদ্রুপ গতি বদলায়, আর এই গতি বদলানোটাই হচ্ছ আধুনিক, ইংরেজিতে যাকে বলে গড়ফবৎহ।’
রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তার পথ ধরে বিশ শতকের শেষার্ধের শক্তিধর কথা সাহিত্যিক ও শিল্পসমালোচক – আলাউদ্দিন আল আজাদ ও প্রায় সিকি শতাব্দ আগে বলে গেছেন- “সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের নবরুপায়নও সম্ভব। একটা পর্যায়ের পর নূতন আঙ্গিকে সাহিত্যে নূতন রূপ ধারণ করে। উত্তর আধুনিকতা এসেছে, এটাই বাস্তব। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের শৈলীগত রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে। শুধু মাত্র কাব্য ক্ষেত্রেই নয়, কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও পরিবর্তিত হচ্ছে।” (সূত্রঃ আলাউদ্দিন আল আজাদের সাক্ষাৎকার- শাকিল আহমদ। দৈনিক পূর্বকোণ- ১০ আগস্ট ১৯৯৭)।
সময়ের সাথে সাথে সমাজ বাস্তবতার পরিবর্তনের ফলে বাংলা ছোট গল্পের পটভ‚মি ও ভাষার ক্ষেত্রে রাবীন্দ্রিক যুগ পার হয়ে শত বৎসর পরে এসে যদিও আমরা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি; তথাপি রবীন্দ্র ছোটগল্পের কাঠামোকে এখনো কেউ উৎরে যেতে পারেনি। এক্ষেত্রে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও সাহিত্য সমালোচক শ্রী সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত তার ‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের ছোটগল্প পরিচ্ছেদে যা বলতে চেয়েছেন তার অংশবিশেষ-
“ছোটগল্প আয়তনে ছোট। তাহার মধ্যে সুদীর্ঘ মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ বা বহু ঘটনার সমাবেশের স্থান নাই। অথচ গল্প-উপন্যাসের প্রাণ হইতেছে তাহার উপাখ্যান, তাহাতে দুই একটি ঘটনা থাকা চাই-ই। মনস্তত্তে¡র গভীর ও ব্যাপক বিশ্লেষণের স্থান নাই বলিয়া যে ক্ষুদ্র ঘটনাকে আশ্রয করিয়া ছোটগল্প গড়িয়া উঠে তাহাকে খুব বেশি মুখ্য করিতে হয়। ‘লিরিক’ কবিতা যেমন একটি ভাবকে আশ্রয় করে, ছোটগল্প তেমনি একটি আখ্যানকে কেন্দ্র করে। তাহার মধ্যে সে যেন সম্পূর্ণ হইয়া থাকে। যে সব গল্পের মূখ্য উদ্দেশ্য কোনো বিশেষ ঘটনার বর্ণনা নহে, সেই সব গল্পেও একটি ঘটনা কেন্দ্র করা হইয়া থাকে; যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’। মুখ প্রকৃতির সঙ্গে মুখ বালিকার আন্তরিক সংযোগ এই গল্পের উপজীব্য কিন্তু তবুও এমন ভাবে গল্পটি লিখিত হইয়াছে যেন সুভার বিবাহ ও তাহার ব্যর্থতার বর্ণনা করাই কবির মূল উদ্দেশ্য ছিল।”
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে তার পারিপার্শিক সময় এবং অবস্তানকেও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের অতুলনীয় কবি প্রতিভা এবং লিরিক (সংগীত) প্রতিভার সমৃদ্ধি নিয়ে যখন আমাদের জীবনের দিকে চোখ ফিরালেন, বাংলাদেশের সহজ-সরল জীবন প্রবাহ যখন তাঁর মনজগৎ আর্কষণ করলো, তখন অতিক্ষুদ্র ও সংকির্ণ বৈচিত্রহীন জীবনেও রসের সম্ভার হলো। কাব্যধর্মীতা তার গল্পগুলোকে শিল্প হিসেবে রসোত্তীর্ণ করে নতুন শিল্প মাত্রাই নিয়ে গেছে। তিনি যেহেতেু একজন কবি, গীতিকার ও গল্পকার, সেহেতু কোনো কোনো গল্পে গীতিধর্মেরও আতিশয্য আসতেই পারে এবং এতে শিল্পমূল্যের কিছুটা ঘাটতিও হতে পারে। কিন্তু তবুও তার গল্পের ক্ষেত্রে ঢালাও ভাবে গীতিময়তার অভিযোগ আনা চলে না। শিল্পরস এবং শিল্পমূল্যের ক্ষেত্রে তার ছোটগল্পকে উৎরে যাওয়ার মতো ছোটগল্প বাংলা কথাসাহিত্যে এখনো আবিভর্‚ত হয়নি, এটাই সত্য।