কাব্যকথায় বাবাকে খুঁজেন প্রদীপ প্রোজ্জ্বল

20

 

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট ডোমখালীতে ১৯৮৫ সালের ২ ডিসেম্বর জন্ম প্রদীপের। শৈশব থেকে সংগ্রামী মানুষটি পাননি বাবা-মায়ের স্নেহ। তবুও থেমে থাকেনি জীবন। পড়ালেখার গন্ডি পেরিয়ে জীবিকার তাগিদে নিয়েছেন সেলুনের কাজ। দোকানদারির ফাঁকে চালিয়েছেন কাব্যচর্চাও। যার ফলশ্রুতিতে মলাটবদ্ধ হয়েছে ৯টি গ্রন্থ। প্রতিভাবান লেখক হিসেবে এখন তাঁর পরিচিতি পাঠকমহলে, নাম প্রদীপ প্রোজ্জ্বল।
২০০৩ সাল থেকে লেখালেখি শুরু হয় প্রদীপ প্রোজ্জ্বলের। কষ্টকে ভুলে থাকার সব উপকরণ তিনি সাজিয়েছেন কাব্য উপমায়। কখনও গভীর রাতের নিস্তব্ধতায়, কখনও বর্ষাভেজা দুপুরে কিংবা চৈত্রের বিকেলে কাগজের পাতায় প্রতিমূর্ত হয়েছে তাঁর কথামালা।
চট্টগ্রামের স্পন্দন প্রকাশন থেকে প্রদীপ প্রোজ্জ্বলের ১ম কাব্যগ্রন্থ ‘দুরন্ত পথ’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এরপর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরুমন প্রকাশনী থেকে ‘অগ্নিবেদীতে তাকিয়ে রই’ প্রকাশিত হয়। গলুই প্রকাশন থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘বৃত্তের আবর্তে’। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ হয় ‘নিশ্চয়ই দাঁড়াবে’। এছাড়া শিশুকিশোর গল্পগ্রন্থ ‘গল্প-কথায় ছড়া’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং গল্পগ্রন্থ ‘জন্ম জন্মান্তর’ বাজারে আসে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে। ২০১৯ সালের মে মাসে ‘পরিত্যক্ত নগর’ এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘খুঁৎ’ ও নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় ‘অন্বিত অর্ধাঙ্গ’।
প্রদীপের মেঝ মামা ভানু চন্দ্র শীল সেলুনের কাজ করতেন চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ক্যান্টনমেন্টে। সেখানকার মালুমঘাট বাজারে সুবেদার নিত্যানন্দ পালের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্যতা। নিত্যানন্দ কর্মরত ছিলেন রাঙামাটির বেতবুনিয়া পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুলের (পিএসটিএস) অধীন চকরিয়ার ডুলাহাজারা উপশাখার প্রশিক্ষক হিসেবে। সময়টা ১৯৮৩ সাল। পুলিশ পাত্র পেয়ে হাতছাড়া করতে চাননি, তাই ঘর-বাড়ির বিস্তারিত খবর না নিয়েই ভানু চন্দ্র তার বোন প্রমিলা বালাকে বিয়ে দেন নিত্যানন্দের সাথে। প্রমিলা-নিত্যানন্দের কোল আলো করে আসেন প্রদীপ। এর মধ্যে খোঁজ নিয়ে চলে আসেন নিত্যানন্দের ১ম স্ত্রী শোভা রানী পাল। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। প্রদীপকে পেয়ে মেনে নেন সতীনকেও। কিন্তু প্রদীপের নিচেই যে অন্ধকার লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে পারেনি কেউ।
পাঁচ বছরের সংসার জীবন শেষে ১৯৮৮ সালে রাজশাহীতে বদলি হয়ে যান সুবেদার নিত্যানন্দ পাল। এরপর থেকে আর স্ত্রী-সন্তানের খবর রাখেননি তিনি। যোগাযোগের ঠিকানা না থাকায় শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণেছেন প্রমিলা বালা। কিন্তু না, ও পথ আর মাড়াননি নিত্যানন্দ। ১৯৯৪ সালে প্রমিলা বালাকে আবারও বিয়ে দেওয়া হয় চকরিয়ার যতীন্দ্র মোহন দে’র সঙ্গে। সেই ঘরে জন্ম নেয় এক পুত্র ও দুই কন্যা।
শৈশবে দিদি মা ও মামার হাত ধরে বেড়ে ওঠা প্রদীপ বাবাকে খুঁজেছেন, মাকে চেয়েছেন গভীর অনুরাগে। এরই মধ্যে প্রদীপ পার হন স্কুলের গন্ডি।
জীবিকার তাগিদে এখন বসবাস চট্টগ্রাম শহরে। চকবাজার আতুরার দোকান এলাকায় তার প্রতিষ্ঠান ‘অদ্বৈত হেয়ার ড্রেসার’। বিয়ে করেছেন তিনি, সংসারে আছে এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারপরও শূন্যতা বুকের মাঝে। সংসার-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামলে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন লেখালেখিতে। কাব্যকথায় খুঁজেন বাবাকে।
দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যক্রমে যা-ই বলি না কেন, আপন মাকে আবারও কাছে পেয়েছেন প্রদীপ। ২০০৫ সালে চকরিয়ায় মারা যান প্রদীপের ২য় পিতা যতীন্দ্র মোহন। আর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর ২০১৩ সালে শুনেছেন, ২০০২ সালেই মারা গেছেন তার জন্মদাতা। বড় মা শোভা রানীর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে প্রদীপ বাবার শেকড় খুঁজে চলেছেন আজও। মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া ঠাকুর হাট বাজার এলাকার সন্ধান পান তিনি। সেখানে আছে বাবার শ্মশান। যদিও নিত্যানন্দ পালের জন্মপল্লীর সন্ধান মিলেনি। অনেকটা কাছাকাছি এসেও ধরা হলো না জন্মদাতাকে। শুধু জেনেছেন-ঠাকুরদা’র নাম ছিল সুরেন্দ্র পাল, আর ঠাকুরমা ইন্দ্রা দেবী। ২০০৮ সালে পৃথিবীর মায়া ছাড়েন তাকে লালন-পালনকারী দিদি মাও। এখন দুই মায়ের দেখাশোনা করছেন প্রদীপ। আপন মাকে রেখেছেন নিজের কাছে। সৎভাইকে নিয়ে সেলুন চালান। রাজনীতি সচেতন প্রদীপ সাহিত্য বিশারদ সুহৃদ চট্টগ্রাম এর অর্থ সম্পাদক, মালুমঘাট শ্রীকৃষ্ণ যুব কল্যাণ সনাতনী সংঘের সহসভাপতি সহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক লোক আসেন প্রদীপের সেলুনে। কথাপ্রসঙ্গে তাদের সাহায্যও চান। কিন্তু সেই ঠিকানা আর মেলে না। প্রমাণ হিসেবে আছে, বড় মায়ের কাছ থেকে পাওয়া বাবার পেনশনের বই। তাই কখনও বেতবুনিয়া, কখনও ডুলাহাজারা কিংবা রাজশাহী, কখনও বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ছুটে যান বাবার আসল ঠিকানার সন্ধানে। বাবাকে না হয় নাইবা পেলেন, জন্মদাত্রীকে তো পেয়েছেন-এটাই এই জীবনে তার কাছে বড় সান্তনা।