কাপ্তাই হ্রদে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু

23

এম. কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি

হাইকোর্টের নির্দেশে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই দিনব্যাপী জেলা শহরের আসামবস্তি, ব্রহ্মণটিলাসহ বিভিন্ন এলাকায় কাপ্তাই হ্রদে অবৈধ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন। অভিযানে বহুসংখ্যক অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিকালে শহরের রিজার্ভমুখ এলাকার শহিদ মিনারঘাট, ফিশারিঘাট, তবলছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের অবৈধ ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রচারাভিযান চালান জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান ও পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ। এ সময় জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের অবৈধ ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে গতকাল মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মিজানুর রহমান এ আদেশ জারি করেন। একই সঙ্গে হাইকোর্টের নির্দেশে কাপ্তাই লেকে সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে যৌথ অভিযান শুরু করে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন। জানা যায়, অবৈধ দখলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে কাপ্তাই হ্রদ। দূষণের শিকার হচ্ছে হ্রদের পানি ও পরিবেশ। এ অবস্থায় কাপ্তাই হ্রদকে অবৈধ দখল ও দূষণমুক্ত করতে দায়ের করা একটি রিটের শুনানি শেষে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের অবৈধ দখল বন্ধ করাসহ দখলদারদের উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম এবং বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর ডিভিশন বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আদেশে কাপ্তাই হ্রদের অবৈধ দখল বন্ধ এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ছাড়াও জরিপ করে হ্রদের সীমানা নির্ধারণসহ অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরির জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ দখল করে স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’- এর পক্ষে ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর রিটটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট মো. ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী ও রিপন বাড়ৈ।
জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের করা রিট পিটিশন নং-১১৮৫’- এর ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর নোটিসের পরিপ্রেক্ষিতে রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় অবস্থিত কাপ্তাই লেকে সব ধরনের অবৈধ ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হাইকোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষাপটে শিগগির কাপ্তাই লেকে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পাঠানো হবে। এছাড়া মঙ্গলবার থেকেই পুরোদমে কাপ্তাই লেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর আগেও অনেকগুলো অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান চলতে থাকবে। জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ যৌথভাবে নিয়মিত এ অভিযান পরিচালনা করবে। এতে অবৈধ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, জনস্বার্থে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে কাপ্তাই হ্রদে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে চলমান অভিযানে জেলা পুলিশের পক্ষে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া হবে।
এদিকে প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযানে চরম আতঙ্কে পড়েছেন অহরহ স্থাপনার দখলদার। তাদের দাবি, পূর্বে কোনো প্রকার নোটিশ না দিয়ে তাদের বাড়িঘর ও স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাড়িঘর ও দোকানপাটসহ নানা সহায় সম্বল হারিয়ে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পরিচালিত অভিযানে শহরের ব্রহ্মণটিলা ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় গুঁড়িয়ে দেওয়া বসতঘরের স্থাপনার মালিক রুনু চক্রবর্তী, তার স্বামী দুলাল চক্রবর্তী ও সুমি বেগম বলেন, তারা অন্যদের কাছ থেকে জমি কিনে তাদের ওইসব স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। এখন কিছুই না জানিয়ে হঠাৎ তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করায় চরম ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এতে বাড়িঘরসহ তাদের প্রত্যেকের ৩০-৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারা অসহায় ও নিরীহ। হঠাৎ এভাবে বসতবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়ায় মানবেতর পরিস্থিতির সম্মুখীন তারা। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিও জানান তারা।
উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকা শহরের আসামবস্তি ব্রিজসংলগ্ন এলাকার স্থাপনার মালিক ভারত কুমার চাকমা, মনিন্দ্র চাকমা, রোহিনী চাকমা, মনতোষ চাকমাসহ অনেকে বলেন, তাদের স্থাপনার জমির সংশ্লিষ্ট মৌজাপ্রধানের সুপারিশসহ দলিলপত্র রয়েছে। ক্রয়সূত্রে অর্জিত তাদের ওইসব জায়গায় দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা তৈরি করেছেন তারা। এভাবে তাদেরকে হঠাৎ উচ্ছেদ করে দেওয়া সম্পূর্ণ অমানবিক। রাঙামাটির প্রায় মানুষ খাস জায়গায় বাড়িঘর করে বসবাস করছেন। উচ্ছেদ করতে হলে খাস জায়গায় বসবাসকারী সবাইকে উচ্ছেদ করতে হবে। আমাদের স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও দিতে হবে।
স্থানীয় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বুলু আসাম ও সম্পাদক জুয়েল দেওয়ান বলেন, কাগজপত্র যাচাই করে এবং বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দরকার। হঠাৎ অভিযান চালিয়ে স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হলে স্থানীয় মানুষজন চরম অমানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। রাঙামাটির মানুষ আর কতবার উচ্ছেদের শিকার হবে? এখানকার মানুষ যাবে কোথায়?
তিনি জানান, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে অসংখ্য মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। এরপর বিভিন্ন পরিস্থিতি, প্রতিক‚লতা ও দুর্যোগে অসংখ্য মানুষকে ভিটেবাড়ি হারাতে হয়েছে।