কাটছে করোনার প্রভাব, ‘চাঙ্গা’ হচ্ছে অনলাইন কেনাকাটা

85

নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছে। প্রায় স্থবির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে। করোনার প্রভাব কাটিয়ে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে অনলাইন কেনাকাটাও। সাধারণ সময়ের চেয়ে অনলাইন কেনাকাটা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ।
তবে অনেক উদ্যোক্তাই বলছেন, অনলাইন কেনাকাটার গতি এখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। আর এই সময়ে সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা হচ্ছে গ্রোসারি, ওষুধ ও নিত্য পণ্য। এছাড়া ঈদকে সামনে রেখে ফ্যাশন আইটেম, হেলথ অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্ট, ইলেকট্রনিক পণ্য কেনাকাটাতেও বাড়তি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, অনলাইনে এখন কেনাকটা বেড়েছে। গত বছর বা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বাড়ছে। কারণ ই-কমার্স সাইট বা অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের ভরসা বেড়েছে। এছাড়া করোনার কারণে ক্রেতাদের বড় একটি অংশ এখন ঘরে বসেই নিত্য পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী। ফলে সাধারণ সময়ের চেয়ে বা লকডাউন শুরু হওয়ার পরে অনলাইনে ক্রেতা বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। মানুষ যেমন জরুরি পণ্য কিনছে, তেমনি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যও কিনছে। তবে বিলাস দ্রব্যের বিক্রি নেই বললেই চলে।
আব্দুল ওয়াহেদ তমাল জানালেন— চাল, ডাল, ওষুধপত্রের মতো পণ্যের বিক্রিই বেশি। তবে ঈদুল আজহা সামনে রেখে অনলাইনে গরু-ছাগল কেনাবেচা জমে উঠবে বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকেও সেরকম সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। আমরাও সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে গরু কেনার ক্ষেত্রে এখনো ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে বোঝাপড়ায় ঘাটতি রয়েছে। গরু কোরবানি করে যে বাসায় মাংস পৌঁছে দেওয়া যায়, এমন সব সেবার সঙ্গে মানুষ এখনো তেমনভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। সাধারণত কোরবানিতে যে পরিমাণ পশু বিক্রি হয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হয় তার খুবই নগণ্য একটি অংশ। এখনো মানুষ হাট থেকে গরু কিনতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে এই প্রবণতাও কমছে। এখন অনেকেই অনলাইনে গরু কিনছে। সবমিলেয়ে অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের আস্থা বাড়ছে।
ই-কমার্স সাইটগুলোও ক্রেতাদের কাছ থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সাড়া পাচ্ছে বলে জানাচ্ছে। দারাজ ডটকম ডটবিডি’র হেড অব পাবলিক রিলেশন সায়ন্তনী তৃষা বলেন, ‘সাধারণ সময়ের চেয়ে অনলাইন কেনাকাটা অবশ্যই বেড়েছে। কারণ এই করোনাকালে এখন সব মানুষই আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। সবাই বুঝতে পারছেন যে এখন অনলাইন কেনাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ।’
সামগ্রিকভাবে বিক্রি বাড়লেও মুদি পণ্য ও এফএমসিজি (ফার্স্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস) ধরনের পণ্যের বিক্রি প্রায় তিন গুণ বেড়েছে বলে জানালেন দারাজের এই কর্মকর্তা। সঙ্গে বললেন ওষুধের কথাও। আর ঈদ সামনে রেখে ফ্যাশন আইটেম, হেলথ অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টসহ মোবাইল ও ইলেকট্রনিক পণ্যের বিক্রিও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে সায়ন্তনী বলেন, লকডাউনের কারণে মানুষের কেনাকাটার ধরনে বড় পরিবর্তন আমরা দেখছি। নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মানুষ এখন অনলাইন কেনাকাটায় বেশি ঝুঁকছে। কারণ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যথাসম্ভব স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ডেলিভারি নিশ্চিত করছে এবং তা সহজেই ক্রেতাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও অনেক নতুন নতুন ক্রেতাও এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে বর্তমান অবস্থা ক্রেতাদের অনলাইন কেনাকটায় মানুষকে নতুনভাবে আগ্রহী করে তুলেছে। তাই বলব কেনাকাটা ভালোই চলছে।
তবে কোনো কোনো উদ্যোক্তা বলছেন, বেচাকেনার অবস্থা এখনো আগের জায়গায় ফিরতে পারেনি। আবার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বা ওষুধের বিক্রি অনলাইনে বাড়লেও বিলাসবহুল পণ্য বা শখের পণ্যের বিক্রি সেই যে কমেছে, আর বাড়েনি। এ অবস্থায় এসব পণ্যের বিক্রেতা ই-কমার্স সাইটগুলোর অবস্থা শোচনীয় বলে জানাচ্ছেন তারা।
ই-কমার্স সাইট বাগডুমের চেয়ারম্যান শামীম আহসান সারাবাংলাকে বলেন, হ্যান্ডিক্রাফটস পণ্য এখনো খুবই স্লো। এখন শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষই মানুষ বেশি কিনছে। সখের জিনিষ কিনছে না বললেই চলে। ফলে অনেক উদ্যোক্তাদের খুব খারাপ সময় যাচ্ছে।
আরেক ই-কমার্স সাইট আজকের ডিল’র সিইও ফাহিম মাশরুর সারাবাংলাকে বলেন, এখনো আগের চেয় কেনাবেচা বেশ কম। ঢাকায় কিছু পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে তেমন কোনো বিক্রিই নেই। কারণ ঢাকার বাইরে এখন মানুষের হাতে তেমন টাকাও নেই। মাঝখানে নিত্য পণ্যের কেনাকাটা বেড়েছিল। তখন মানুষ কম বাইরে যেত। এখন আবার মানুষ বাইরে যাচ্ছে। তাই নিত্য পণ্যের কেনাকাটাও কিছুটা কমেছে। আর করোনার আগের চেয়ে অর্থাৎ সাধারণ সময়ের চেয়ে এখন কেনাবেচা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম। আর ফ্যাশন আইটের মধ্যে শাড়ি, থ্রি পিস, প্যান্ট, শার্ট ও নারীদের প্রসাধনী সাধারণ ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো। কিন্তু এখন ঈদের আগেও এসব পণ্যের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ওষুধ, মাস্ক ও স্যানিটাইজার সামগ্রী।
এদিকে ঢাকার বাইরে উপজেলা শহরগুলোতেও অনলাইন কেন্দ্রিক কেনাবেচা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বলে জানা গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় অ্যাঞ্জেল বুটিকস নামে একটি শোরুম গড়ে উঠেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির বেচাকেনা মূলত অনলাইন কেন্দ্রিক। গফরগাঁওসহ সারাদেশেই তারা তাদের পণ্য সরবরাহ করছেন। বিক্রির মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক পেজকেই প্রধান্য দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা নওমা আলী ঐশী। প্রায় প্রতিদিনই ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে এসে এসে থ্রিপিসসহ নারীদের নানা প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি করছেন তিনি।
জানতে চাইলে সারাবাংলাকে ঐশী বলেন, ২ বছর আগে সখের বসে মাত্র ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। তখন আমার অন্য একটি পেজ ছিল। সেখানে কেনাবেচা ভালোই হতো। এছাড়া উই (নারী উদ্যোক্তাদের গ্রূপ) গ্রূপেও কিছুটা সক্রিয় ছিলাম। পরে চলতি বছরের জানুয়ারিতে গফরগাঁওয়ে শোরুম দিয়েছি। প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ করেছি। শুধু গফরগাঁও নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা অর্ডার পাচ্ছি। তেমন কোনো কুরিয়ার সার্ভিস না থাকা সত্তে¡ও আমরা ঠিক সময়ে ডেলিভারি দেওয়ার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে কর্মচারীদের ময়মনসিংহে পাঠিয়ে গ্রাহকদের পণ্য ডেলিভারি দিয়ে থাকি। এছাড়া প্রতিদিনই ফেসবুক থেকে লাইভে এসে পণ্য সম্পর্কে গ্রাহকদের জানাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা পাইকারি হিসেবেও পণ্য বিক্রি করে থাকি। এখন প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি রয়েছে আমাদের। আর বিভিন্ন সময়ের বিনিয়োগসহ এখন মূলধন প্রায় ৩০ লাখ টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, করোনার কারণে আমরা থেমে নেই। আমাদের ব্যবসা ভালোই চলছে। প্রতিদিনই আশানুরূপ অর্ডার পাচ্ছি অনলাইনে। পাশাপাশি শোরুম থেকেও বিক্রি ভালো।
ফেসবুকে কাতান, বেনারসি, সুতি কাপড় ও শাড়ি বিক্রেতা পেজ ‘অংশু’। এর উদ্যোক্তা তানজিলা হক সারাবাংলাকে বলন, সাধারণ সময়ের চেয়ে বেচাকেনা অনেক কম। সাধারণ সময়ে যেমন বিক্রি হয়, এখন তার ২০ থেকে ৩০ শতাংশও বিক্রি করতে পারছি না। এখন খরচ তোলাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্ডার ভলিউম খুব একটা বাড়েনি। গেল ঈদে যাও বিক্রি হয়েছে, এবার সেই তুলনায় বিক্রি একদমই নেই।
হ্যান্ডমেড শাড়ি, পাঞ্জাবি ও বাচ্চাদের কাপড় বিক্রির একটি ফেসবুক পেজ ‘রংধনু ক্রিয়েশন’। এর উদ্যোক্তা শাহনাজ সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, করোনা শুরুর প্রথম দিকের চেয়ে এখন বেচাকেনা বেড়েছে। লকডাউনের সময় বেচাকেনা শূন্যে নেমে এসেছিল। তা এখন অনেক বেড়েছে। তবে সাধারণ সময়ে যেমন বেচাকেনা হয়, এখনো সেই অবস্থায় ফেরা সম্ভব হয়নি। তবে দুই-তিন মাস আগে যে অবস্থা ছিল, এখন তারচেয়ে ভালো।