কাঁধের উপর সাতরাজার ধন অধম মা-বাবার চিরক্রন্দন

127

পৃথিবীটা বড় কষ্টের, মাঝে মাঝে মনে হয় সে আর আমার নয়। বেঁচে থাকাটা যেন আমার স্ত্রীর কাছে অর্থহীন, বলেন পৃথিবী এখন আর আমাদের না। যে বাবা-মার তরতাজা জোয়ান সন্তান সব ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে যায় সে বাবা-মার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে যেন একেকটি বছর। মাঝে মাঝে নিজেকে বড় নির্লজ্জ মনে হয়, বেঁচে থাকাকে অভিশাপ মনে হয়। নিজের সদা প্রাণোচ্ছল তাগড়া সন্তানটি চলে যাওয়ার পর নিজের বেঁচে থাকাকে কেবলই অপরাধ মনে হয়। মনে হয় প্রতিটি নিঃশ্বাস গ্রহণ করা, প্রতি গ্রাস খাদ্য খাওয়া, মাটির উপর হেঁটে চলা যেন মহাপাপ। হৃদয়টা আজ বড় বিদীর্ণ, আবারও এলো ১ সেপ্টেম্বর, আমার তানাজ মারজান, আমার নিভা, আমার সাতরাজার ধন, আমার একমাত্র কন্যাটি চলে যাবার পুরা তিনটি বছর পূর্ণ হল।
মাগো, চলে তো গেলি কিন্তু কেন রেখে গেলি অধম, অসহায় তোর এ মা-বাবাকে? তোর একমাত্র নিশান, তোর সন্তানটিকেও তো মা রেখে যেতে পারলি না। কি যে দোষ আমি করেছিলাম খোদা তোমার কাছে, আমার এত সুন্দর মেয়েটির সাথে তুমি আমার নিস্পাপ নাতিটাকেও নিয়েগেলে। পৃথিবীর আলোটাও তাকে দেখতে দিলেনা, হায়রে খোদাÑ এমন কষ্ট তুমি অধম মা-বাবাকে কেন দাও? আল্লাহ্ এ অধমের কথায় কোন ত্রæটি নিওনা মালিক, অসন্তুষ্ট হইওনা, তোমার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পন করলাম। শুধু ফরিয়াদ হে খোদা, সে ডাক্তারকে তুমি ক্ষমা করো না মাবুদ, যে আমার নাতিকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেয়নি। যে আমার নিরপরাধ-¯েœহময়ী কন্যাটিকে প্রসবকালীন সময়টিতে চরম অবহেলা করেছে। সে ডাইনীকে আমি কঠিন অভিশাপ দিচ্ছি, সে তার পেশাকে ব্যবসা বানিয়েছে সেবায় রাখেনি ডাক্তার নামের কলঙ্ক সে। তুমি তাকে ক্ষমা করো না মালিক, কঠিন শাস্তি দাও এই পৃথিবীতেই দাও, সে এক মা-বাবার আশাকে চরম আঘাত করেছে।
আজ আমার নাতিটি বেঁচে থাকলে তিন বছর পূর্ণ হতো, আমার আর তার নানীর পৃথিবীকে সে ভরিয়ে দিত। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে আমি আমার নাতিটিকে আকাশের ঐ চাঁদটি পেড়ে দিতাম। সে যদি চাইতো আমি যেন দূর আকাশের তারাগুলোকে তার হাতে এনে দিতাম। আমার সে আশা আজ ভেঙে খান খান হয়েছে, আমার নাতিটিকে আমি পেয়ে হারালাম। আমার মেয়েকে আমি দুচোখে চেয়ে চেয়ে বিদায় জানালাম, পারলাম না কিছুই করতে। নিজেকে তখন বড় অসহায় মনে হয়, মনে হচ্ছিল আমার মত অক্ষম, অধম, অপদার্থ বাপ পৃথিবীতে আর নাই যার নিজের মেয়েটিকে বুকে ধরে রাখার ন্যূনতম সামর্থ নাই। আজ আমার নাতিটি যদি থাকত নিশ্চয় সে নানাবাড়ি এসে চেঁচামেচি করে, ছুটাছুটি করে, দুরন্তপনা করে আমার ঘরটাকে মাথায় তুলত। তার উৎপাতে, তার উপদ্রবে আমরা মনে হয় নবজীবন ফিরে পেতাম আমাদের জীবনটা মনে হয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত, আজ আমি সব হারালাম। যখন বৈশাখী মেলা আসে মনে হয় সব খেলনা, সব খাবার আমার নাতির জন্য পাঠাতাম, আমার মেয়ের জন্য পাঠাতাম। যখন ঈদ-পার্বণ আসে মনে হয় অনেক কাপড়, অনেক উপহার আমার নাতির জন্য, আমার মেয়ের জন্য পাঠাতাম, আজ আমি বড় অক্ষম কিছু করতে পারছিনা। সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে না পেরে মায়ের যে যন্ত্রণা, বাচুরকে দুধ দিতে না পেরে গাভীর যে বেদনা, ঠিক তেমন বেদনা আমার মনেÑ দিতে না পারার বেদনা। মেলা আর ঈদবাজারে দেখা মনকাড়া সব বস্তুগুলো হৃদয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে বেদনার অশ্রæ রূপে দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। ঘরে ভালো কিছু রান্না হলে কান্নায় আমার স্ত্রীর দুই চোখ ভেসে যায়, আমার মেয়েটি মায়ের হাতের রান্না বড় বেশি পছন্দ করত। কন্যা আর নাতি বেঁচে থাকলে কত কিছু যে রান্না করে তিনি তাদের খাওয়াতেন তার কোন সীমা-পরিসীমা থাকতো না। আজ তাঁর হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ, অন্তর ক্ষতবিক্ষত, মনের সব সাধ, সকল আহ্লাদ আজ চোখের পানি হয়ে দুই গাল ভাসিয়ে যায়।
একটি সন্তানের অভাব এ পৃথিবীতে কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ হবার নয়, সেই সন্তানের বিয়োগ বাবা-মার জগতকে অন্ধকার করে দেয়, তাদের হৃদয় ভেঙ্গে খান খান করে দেয়। পৃথিবীতে যেমন সব চাইতে নিরাপদ বৃক্ষ বাবা-মা তেমন পৃথিবীতে সব চাইতে মিষ্ট ফল সন্তান, সন্তানের শূন্যতা কোন কিছু দিয়েই পূর্ণ হয় না। ঠিক তেমন নাতি-নাতনীও বড় মহব্বতের জিনিস, যখন মেলা আসে, জব্বারের বলী খেলা হয়, ঈদ-পার্বণ আসে আমার কেবলই মনে হয় আজ আমার নাতিটি যদি বেঁচে থাকত তাকে নিয়ে পুরা শহর আমি চষে বেড়াতাম। হুজুর (স.) যেমন করে ঘোড়া সেজে হযরত হাসান-হোসাইন (রা.)কে পিঠে চড়াতেন আমিও তেমনই কাঁধে করে আমার নাতিকে শহরময় ঘুরে বেড়াতাম; বারবার এ কথাটিই খালি মনে হয়। আজ বুঝতে পারছি নবী (স.) কেন হযরত হাসান-হোসাইন (রা.)কে এত ¯েœহ করতেন? ভাগ্যটা আমার বড়ই খারাপ আমি পারলাম না আমার নাতিকে তেমন করে স্নেহের পরশ দিতে, এযে কি কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। নিজের চোখের সামনে দিয়ে মেয়ে চলে গেল, নাতি চলে গেল তাই বেঁচে থাকাটাকে নিজের কাছে বড় অর্থহীন মনে হয়। পৃথিবীর পথে হেঁটে চলা, পৃথিবীর মাঝে বিচরণ করা মনে হয় অতি লজ্জার। এ অধিকার তো আমার মেয়ের আমার নাতির, আজ বেঁচে থেকেও আমার জগৎ অন্ধকার। পৃথিবীতে পরিবার আল্লাহ্র বড় নিয়ামত, বাবা-মা, পুত্র-কন্যা, স্বামী-স্ত্রী, নাতি-নাতনি সব মিলে পৃথিবী এক স্বর্গ। এখান হতে কারো অপ্রত্যাশিত বিয়োগ, কারো অকাল বিদায় বড় হৃদয়বিদারক এটি কারো কাম্য নয়। একটি মৃত্যু সারাজীবনের কান্না তাই মনেরাখা উচিৎ কারো অবহেলা যেন অন্যের জীবন বিপন্নের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। আমার মেয়েকে আমি সাতরাজার ধন খালি নয় সাতকোটি রাজার ধন ব্যয় করেও আর ফিরে পাব না, আমার নাতিকেও পাব না। যার গিয়েছে কেবল সে’ই বুঝে অন্যে কখনো নয়, তারপরও সংশ্লিষ্ট সকলের পরের ব্যথাকে নিজের ব্যথা ভেবে একে অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার নাম মানবতা।
আহা মানবতা আজ ধুলায় লুটে, নবীজি মোহাম্মদ (স.)’র হাদিস মনে পড়ল। নবীজি বলেছেন, শেষ জামানায় মানুষের আচার হবে নবীদের মতো আর বিচার হবে ফেরাউনের মতো। আজ মনে হচ্ছে সে সময় এসে গেছে, মানুষের হৃদয় বাঘের হৃদয় হয়ে গেছে, মানুষের প্রতি মানুষের মায়া-মমতা সব যেন হারিয়ে গেছে। কিভাবে মানুষ একে অন্যকে কুপিয়ে হত্যা করছে, গুম করছে, খুন করছে, লাঠির আঘাতে পিটিয়ে মারছে। গুজব ছড়িয়ে, কুৎসা রটনা করে, অপপ্রচার চালিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। মানুষ আজ পিশাচে পরিণত হয়েছে, বাবা-কন্যা, চাচা-ভাতিঝি, মামা-ভাগ্নি কিছুরই পরিচয় যেন আজ নাই, পৃথিবী নরকে রূপ নিয়েছে। কন্যা হারিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী পাগল প্রায়, ১ সেপ্টেম্বর ঘনিয়ে এলে আমাদের অন্তরে দোজখের আগুন জ্বলে। মানুষ এত পাষাণ হয় কেমন করে? ধর্ষণ নামক এই কুৎসিত অপকর্মটি, এই দানবীয় কাজটি আমার মনটিক ভেঙে চূরচূর করে ফেলছে, এই শব্দটি আমার মুখে নিতে ঘৃণা করছে। আমার হৃদয়ে আজ আমার নিভা অনেক পবিত্রতা বিলিয়ে বাপ-মেয়ের চির মধুর মমতাকে অনাবিল স্বর্গীয় আবেশে ভরিয়ে তুলছে। এ মায়া, এ ¯েœহ অনেক পবিত্র, তারচেয়ে আরো মধুর যেন নাতির উৎপাত। অতি ধনী কিন্তু অধিক কৃপণ পিতা যজ্ঞনাথকে ছেড়ে বৃন্দাবন যখন নিজ পুত্র গোকুলচন্দ্রকে নিয়ে গৃহত্যাগ করল, ব্যয় কমেছে ভেবে যজ্ঞনাথ বড় খুশি হল। কিন্তু দুদিন যেতেই সে বুঝতে পারল তার চার বছরের নাতি গোকুলচন্দ্র কি ছিল? গোকুলের উৎপাত, উপদ্রব, অত্যাচারহীনগৃহ আজ যজ্ঞনাথের কাছে যেন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। তার কোটি কোটি টাকার স্বর্ণকলস ভর্তি সোনার মোহর তার কাছে আজ দু’পয়সারও মূল্যহীন। নাতির জন্যে আজ উন্মাদ সে আজ পাগল নাতিকে ফিরে পেতে। নাতি একদিন ফিরে আসবে আশায় নাতির গচ্ছিত সম্পদের নিরাপত্তায় নিজের অজান্তে নিতাইকে বলি দিয়েছে মাটি চাপা দিয়ে! যখন জানল নিতাই’ই তার নাতি গোকুল তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। নাতি শোকে শোকাকুল যজ্ঞনাথ বিদীর্ণ বুক নিয়ে সংসারের এই লুকোচুরি খেলা হতে চির অন্তর্হিত হলো। রবিন্দ্রনাথের ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ নাতিকে করেছে মোহন। আমার মেয়েটি ছিল অনেক ¯েœহময়ী, অনেক মমতাময়ী অনেক আপন। ঘরে এসে যখন বালিশে মাথাটা রাখতাম মেয়েটি আমার কাছে এসে মাথায় তার হাতটি রাখতÑ আহ্ এর মত সুখ কোথাও কি আছে আর পৃথিবীতে? আমার মারজান, আমার মহামূল্য স্বর্গীয় রতনটি আজ বহুদূরে আমাকে ছেড়েÑ পবিত্র কোরআন হতে নামটি রেখেছিলাম।
পারিবারিক সম্পর্কগুলো অতি মধুর, বড় স্বর্গীয়, এই ¯েœহ, মমতা, ভালোবাসা হতে কখনো কেউ কাউকে বিচ্ছিন্ন করোনা। একটি মৃত্যু বড় বেদনা, এ যন্ত্রণা কখনো ভুলা যায় না, স্বজনের জন্য, পরিবারের জন্য আপনজন হারানো বড়ই মর্মান্তিক। জানি মৃত্যুকে রহিত করা অসম্ভব, তবে অবহেলা জনিত মৃত্যু, প্রতিহিংসার কারণে মৃত্যু, লোভ জনিত মৃত্যুÑ এসব তো আমরা চাইলে বন্ধ করতে পারি। আজ ডাক্তারের অবহেলায় প্রসূতি মায়ের মৃত্যু, চালকের বেপরোয়া গতির ফলে যাত্রী-পথচারীর মৃত্যু, ক্ষমতার দাপটে অসহায় মানুষের মৃত্যু, র‌্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ারে মৃত্যু, সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যু, গণপিটুনীতে মৃত্যু, প্রতিহিংসায় মৃত্যু, সা¤্রাজ্যবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু। চারদিকে শতশত মৃত্যু, প্রতিটি মৃত্যু আমাকে কাঁদায়, সেপ্টেম্বর আমাকে কাঁদায়, আমি শুধু নীরবে কাঁদি হত্যা থামাতে পারিনা। প্রতিটি মৃত্যু তার পরিবারের জন্য অসহনীয় বেদনা তোমরা এ মরণখেলা বন্ধ কর, যুদ্ধ বন্ধ কর, মানুষকে বাঁচতে দাও। যে জীবন তোমরা দিতে পারনা তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারো নেই, তা কেবল স্রষ্টার দান একমাত্র তিনিই তার মালিক। অতএব আল্লাহকে ভয় কর, মানুষকে ভালোবাস এবং স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত কর। আমার মেয়েকে তুমি খোদা পরম শান্তিতে রাখÑ আমিন।

লেখক : কলামিস্ট