কষ্ট ও ক্যাসিনো

112

কখনো এভাবে হবে চিন্তাই করিনি। বার বার কথাগুলো মনে পড়ছে। আমার সুন্দর সুন্দর চিন্তাগুলো বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে। এক একটা স্বপ্নের আবেগ মুছে যেতে না যেতেই আরো একটা স্বপ্ন এসে ধরা দেয়। স্বপ্নগুলো কিন্তু আগাম জানান দিয়ে যায়, এভাবে না ওভাবে অথবা ওভাবে না এভাবেই হবে। কখনো কখনো শরতের নীল আকাশে সাদা শুভ্র-মেঘের মত সুন্দর সুন্দর স্বপ্নগুলো মনের ভেলায় আসতে থাকে। আবার কখনো কখনো বর্ষার আকাশে কালো কালো মেঘের মত জমাট বাঁধতে থাকে। সেই মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির মত স্বপ্নগুলোও ঝরে পড়ে। ক্ষতের সৃষ্টি করে। কাঁদতে ইচ্ছে হয় না। কেন কাঁদবো? ভালো লাগা মুহূর্তগুলোর যে চরম শক্তি আছে তাতো আমার সম্পদ। সেই ক্ষতও গভীর। সহজে যেতে চায় না। কষ্ট লাগে। ভীষণ কষ্ট লাগে। কবি হেলাল হাফিজের সেই কতিকাটা মনে পড়ে- ‘কষ্ট নিবে? কষ্ট/লাল কষ্ট নীল কষ্ট’ আসলে কি কষ্টের কোন রং আছে। অবস্থান ভেদে সব কষ্টগুলো ভিন্ন। পরিবেশ ভেদে কষ্টগুলো অন্যরকম। মানুষ ভেদে কষ্টগুলো রূপ বদলায়। খেতে না পাওয়ার কষ্ট, কাপড় না থাকার কষ্ট, লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার কষ্ট, ঔষধপতি না পাওয়ার কষ্ট, শখ-আহলাদ পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ার কষ্ট। আর যারা ক্যাসিনো চালায় তাদের কষ্টটা কোথায়? তা আমার পক্ষে বোধগম্য নয়। অতৃপ্ত বাসনায় সেই স্বপ্ন চূড়ায় ওঠার কষ্ট হয়ত। দেশের শ্রমশক্তির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বেকারের সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। সন্তোষজনক কাজ পাননি ১ কোটি ৩৮ লাখ। ১৫ থেকে ৬৪ বয়সী কর্মক্ষম আছেন প্রায় ৬ কোটিট ১৯ লাখ। স্বপ্ন চুড়ায় ওঠার সিঁড়িটা একেক জনের কাছে এক এক রকম। কেউ কেউ অতি সহজেই সেই শিখড়ে উঠতে চায়। আবার কেউ কেউ শত চেষ্টা করে সেই সিঁড়ির খোঁজ পায় না। আবার কেউ কেউ সিঁড়ির সন্ধানে এক সময় নানান অপরাধে জড়িয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের একটি বিরাট সমস্যা হচ্ছে মাদক। মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে অনেকই একদিনে বড় লোক হতে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলে। যারা মাদক সেবন করে তারা মাদকের টাকার জোগাড় করতে গিয়ে ছিনতাই ও চুরি করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যদের জিম্মি করে টাকা জোগাড় করছে। আর যারা মাদক ব্যবসা করছে তারাও অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন খবরের কাগজগুলোতে যে হারে মাদক পাচারের সংবাদ প্রকাশিত হয় তাতে আমাদের প্রজন্মের জন্য একটি ভয়ংকর পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাচ্ছি। তাছাড়া বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই রাজনীতিকে উপর উঠার সিঁড়ি হিসেবে বিবেচনা করে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। আমাদের ছাত্র রাজনীতি এক সময় গৌরবময় ইতিহাস ছিল। এদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে যারা এদেশের বয়স্ক ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ আছেন তাদের সবাই এক সময় ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। কিন্তু দিন যতই ততই এই গৌরবের ইতিহাস ম্রিয়মান হচ্ছে। কুলষিত হচ্ছে। রক্তাক্ত হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে মারামারি-হানাহানি-খুনাখুনির ঘটনা এখন নিত্যমিত্ত ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। ছাত্র রাজনীতি এখন দেশের রাজনীতিতে মাথা-ব্যাথার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে, একশ্রেণীর তরুণ-তরুণী আছেন (১৫-১৯ বছর বয়সী) যারা কাজের মধ্যে নেই, আবার পড়াশুনার বা প্রশিক্ষণেও নেই। তাঁরা আসলে ছদ্মবেকার। এদের সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ। এ ধরনের উচ্চ হারের নিস্ক্রিয় তরুণ গোষ্ঠীর কারণে জনসংখ্যা বোনাসের সুযোগ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে হলে জনসংখ্যাকে জন-সম্পদে পরিণত করতে হবে। আমাদের যে মেধাবী শিক্ষার্থী আছে উপযুক্ত সুযোগের অভাবে সে মেধাকে কাজে লাগাতে পারে না। তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত দেশে এত বিপুল পরিমাণের মেধাবী জনসংখ্যা নেই। তাই এই মেধা ও শ্রম লাগাতে হলে শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয়। এই সিদ্ধান্তের কার্যকরী বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
স্বপ্ন চূড়ার সিঁড়িটা অনেক কঠিন। বাস্তবতার কসাঘাতে সেই সিঁড়ি কখনো কখনো পিচ্ছিল ও বিপদজ্জনক হয়। আবার কখনো কখনো জীবন সমাপ্তিও হয়ে যায়। আমাদের সমাজে এমন এমন মহামানব আছেন যারা শূণ্য থেকে স্বপ্ন চূড়ায় উঠেছেন। জীবনের প্রতিটি স্তরে কঠিন পরীক্ষা ও বাস্তবতার মুখোমুখী হয়ে জীবনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগোতে থাকেন। ২১/০৯/২০১৯ইং তারিখের প্রথম আলো পত্রিকাতে দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা সংবাদ সকলের নজরে পড়ে। একদিকে শূন্য থেকে স্বপ্নচূড়ায় উঠা রাহুল গ্রæপের চেয়ারম্যান রনজিৎ পালিতের সংবাদ আর অন্যদিকে ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে জড়িত যুবলীগ নেতা জিকে শামীমের সংবাদ। রনজিৎ পালিতের যাত্রা ছিলেন এক ঝাঁক মানুষের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার। দেড় দশক আগে যে জনপদ ছিল অনাহার-অভাবে থাকা মানুষের আবাসস্থল আজ- সেই জনপদ সম্পূর্ণ আধুনিকতার ছোঁয়ায় সাজিয়েছে। একই তারিখে একই পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার সংবাদ পড়ে আমি অবাক হয়ে যাই। একজন ন্যায়ের সাথে আলোর পথে আর একজন অন্যায়ের পথে অন্ধকারের রাজ্যে এগিয়েছে। আমাদের সামনে অনেক অনেক আলোকিত মানুষ আছে যারা তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা-শ্রম দিয়ে দেশ ও দেশের মঙ্গলে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিটি সদস্যোর একটি স্বপ্ন থাকে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হব। দেশ ও সমাজের জন্য ভালো কিছু করব। কিন্তু বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতে যখন সেই স্বপ্নের ধাপে ধাপে আঘাতের সম্মুখীন হয় তখনই সৎ ভাবে এগোতে পারে না। অসৎ ও অন্ধকারের পথটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এগোতে থাকে। বর্তমান সময়ে দুইটি ঘটনা সারা বাংলাদেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। একটি ক্যাসিনো কেলেংকারী আর একটি বুয়েটের আবরার হত্যাকাÐ। এই দুইটি ঘটনার সাথে রাজনীতির অপব্যবহার জড়িত আছে। যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত তারাও অনেক অনেক মেধাবী ছাত্র। তারা একটি সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক মোহে ও ক্ষমতার লোভে আমাদের এই আদরের সন্তানরা এক সময় অন্ধকারের পথে এগোতে থাকে। এই ব্যর্থতা সম্পূর্ণ প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর পড়ে। কারণ এক দিনে কেউ এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়াতে পারে না। প্রশাসনের নির্লিপ্ত কর্মকাÐ ও রাজনৈতিক ছত্র-ছায়ায় এই দেশের অনেক মেধাবী ছাত্র অন্ধকারে তলিয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই খুব কষ্টের ও অভাবের মধ্যে বড় হয়ে- যখন ক্ষমতা ও টাকার হাতছানিতে নতুন ও বিলাসবহুল জীবনের সংগ্রামে আসে তখন মেধা ও শ্রমকে ভুলে গিয়ে অন্য এক জগতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। এভাবে আমাদের আদরের সন্তানরা বিপথে যায় ও অন্ধকারে যায়। আমরা তাদের মেধা ও শ্রম থেকে বঞ্চিত হয়। এদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশের আর্থিক কষ্ট থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক মেধাবী ছাত্র/ছাত্রী আছে। উপযুক্ত পরিচর্যা ও সুযোগের অভাবে শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ও নি¤œ আয়ের সন্তানরা যথাযথ সুযোগ-সুবিধার অভাবে এগোতে পারে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা স্বীয় চেষ্টায় ও পরিবারের সহযোগিতায় অনেক দূর এগোতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া শেষে চাকুরী জীবনের সন্ধানে নতুন নতুন অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতায় বার বার ধাক্কা খেতে থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকারদের চাকরি পেতে রীতিমতো লড়াইয়ে নামতে হয়। ¯œাতক পাস করার পর প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনকে কমপক্ষে এক থেকে দুই বছর বেকার থাকতে হয়। আর এই বেকার জীবনের বিভীষিকার ফলে অনেক যুবক অন্যায় পথে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হয়। যারা কালো টাকার গন্ধ ও ক্ষমতার মোহে নিজেকে একবার জড়িয়ে যায় তারা আর পিছনে ফিরতে পারে না। এভাবে এক একজন সম্রাট, সেলিম ভূইয়ার জন্ম হয়। তবে এদেরকে যারা ব্যবহার করছে তারাও এই অন্যায়ের সাথে সরাসরি জড়িত। তাই কেউ কষ্ট করে জীবন যাপন করছে, কেউ কষ্ট করে বড় হচ্ছে। কেউ কষ্টকে ব্যবহার করছে। কেউ আবার কষ্টকে বিলাসিতায় রূপ দিচ্ছে।

লেখক: ধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ডাঃ ফজলুল- হাজেরা ডিগ্রী কলেজ।