কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে কবে, দুর্ঘটনার পরে ?

2

৩০ সেপ্টেম্বর একটি স্থানীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিটি একটি পুরনো দেয়ালের। দেয়ালে একটি সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে। তাতে লেখা-‘সতর্কীকরণ’ সীমানা প্রাচীরটি ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করুন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেই দেয়াল ঘেঁষেই ফুটপাতে হকাররা বসেছে লাইন ধরে। আর মানুষ তো হাঁটাচলা করছেই। ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমানা প্রাচীরটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সাইনবোর্ডও সাঁটানো রয়েছে। কিন্তু মানছে না কেউ। ফুটপাতে বসে হকাররা। চলাচল করে পথচারী। নিউমার্কেট থেকে কোতোয়ালি মোড় হয়ে কোর্ট বিল্ডিং পর্যন্ত সড়কটি খুবই ব্যস্ত। এমনকি ফুটপাত পর্যন্ত। বিশেষ করে সিডিএ বিল্ডিংয়ের গেট থেকে কোর্ট বিল্ডিংয়ে ওঠার সড়ক পর্যন্ত হকার-ক্রেতা আর পথচারীদের ভিড়ে এই ফুটপাত দিয়ে চলাচল করা মুশকিল। তেমন একটি স্থানের পাশের দেয়াল যদি বিপজ্জনক অবস্থায় থাকে তাহলে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কি কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্ব শেষ করতে পারে? দেয়ালটি ভেঙে পুনর্নির্মাণের ব্যয় বা কতটুকু ? সময়-ই বা আর কত লাগবে? নাকি একটি দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত, কারো মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে না।
মনে পড়ে কয়েকবছর আগে সেন্ট প্লাসিডস স্কুল মাঠের সীমানা দেয়ালধসে স্কুল থেকে সন্তানকে আনতে যাওয়া পিতাসহ শিশুশিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেয়ালধসে পিতা-পুত্র দুজনেই নিহত হয়েছিলেন। সে ঘটনাটিও ছিল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার একটি দৃষ্টান্ত। এমন আরেকটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টির জন্য কি তবে আমাদের অপেক্ষা? নাকি প্রশ্ন উঠতে পারে, ফুটপাতে হকার বসা বেআইনি কাজেই দেয়ালধসে হকার মরে গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী হবে না? ফুটপাত দখল করে যে হকার বসে সে ব্যর্থতাও তো কর্তৃপক্ষের। তারপরও কি তাদের মেরে ফেলার অধিকার কারো আছে? আর তাছাড়া পথচারী মারা গেলে? একটি প্রাণের ক্ষতিপূরণ কি কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে? আমি তো মনে করি ক্ষতিপূরণ কে দেবে তা নয়, তখন বাহাস হবে দেয়াল পুনর্নিমার্ণের দায়িত্ব কার ছিল তা নিয়ে। হয়ত এই বিতর্কের নিচে চাপা পড়ে যাবে দুর্ঘটনার বিষয়টি। শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার মৃত্যু হয়েছিল আগ্রাবাদে নালায় পড়ে। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। সেদিন আগ্রাবাদে নবী টাওয়ারের কাছাকাছি নাছিরছড়া খালে পড়ে তলিয়ে যান শিক্ষার্থী সাদিয়া। পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় তার লাশ উদ্ধার হয়। সাদিয়ার ঘটনাটির মাসখানেক আগে ২৫ আগস্ট মুরাদপুর এলাকায় খালে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামে এক ব্যক্তি। এর আগে একই বছরের ৩০ জুন ষোলশহর ২ নম্বর গেইটের মেয়র গলিতে বৃষ্টির সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নালায় পড়ে গেলে তাতে দুইজনের মৃত্যু হয়। এ সময় আহত হন আরও তিনজন। তারও আগে ২০১৯ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে স্ল্যাবহীন নালায় পড়ে ভেসে গিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল বাকলিয়া থেকে।
হাই কোর্টে সাদিয়ার মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করে সাদিয়ার পরিবার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র। ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট রুল জারি করেন। পাশাপাশি কার অবহেলায় সাদিয়ার মৃত্যু, তা অনুসন্ধান করে হাই কোর্টে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সে অনুসারে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার তানভীর হাসান চৌধুরীকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় সিডিএর ফুটপাত সংস্কারের সময় নালার ওপরের অংশ সংস্কার করে অথবা নালাটির সম্মুখ অংশ সুরক্ষিত করে এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।’ অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ সঠিক দায়িত্ব পালন করলে এমন দুর্ঘটনা রোধ করা যেত বলেই তারা অভিমত দিয়েছেন। এমন অনেক বিয়োগাত্মক ও মর্মান্তিক ঘটনা আমরা কিছুদিন যেতে না যেতেই ভুলে যাই। ভুলে যাই কারণ এমন আরেকটি ঘটনা আগের ঘটনাটিকে চাপা দিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমাদের অনুভূতি ভোতা হয়ে যায়, দুঃখগুলো গা সওয়া হয়ে যায়। অথবা এটাও হতে পারে যে, বেশি মানুষের দেশ বলে হয়ত দুচারজন মানুষের মৃত্যু আমাদের খুব বেশি ব্যথিত করে না। এমনকি কারো অবহেলায় মৃত্যু হলেও।
এমন ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কারণে। যদি নালায় ¯স্ল্যাব বা যথেষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। এখন প্রশ্ন হলো এই কর্তৃপক্ষকে দায় নিতে বাধ্য করবে কে ? সে সংস্থার জবাবদিহি কে নিশ্চিত করবে? এমন ঘটনার পর দায় নিয়ে কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছে বলে শুনিনি। ব্যর্থতা বা কর্তব্যে গাফেলতির কারণে কাউকে অভিযুক্ত করা তো দূরের কথা প্রশ্নও তোলা হয়নি। অর্থাৎ নাগরিকদের জীবন কতটা নিরাপদ তা নিয়ে ভাববারও সময় নেই কারো।
সাদিয়া, সালেহ আহমদরা বা ফুটপাতের হকার কিংবা পথচারীরা সাধারণ মানুষ। এমন দুচারজন সাদিয়া, সালেহ আহমদদের মতো সাধারণ মানুষ বানের তোড়ে ভেসে গেলেও তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু হয় না। প্রশাসনের খুুব বেশি টনক নড়ে না। কাউকে কোথাও জবাবদিহিও করতে হয় না। সেবা সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে রেহাই পেতে চান। এ যেন ব্যাডমিন্টন খেলা। টেনিস বা ভলিবলও বলতে পারেন। নগরবাসীকে কর্ক কিংবা বলের মতো একপক্ষ তীব্রভাবে ঠেলে দিচ্ছে বিপরীত কোর্টে। ওপক্ষ ঠেলে দিচ্ছেন এ কোর্টে। প্রকৃত বিচারটি হবে না। দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ হবে না। মাঝখানে কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কারণে জীবন যাবে, ক্ষতিপূরণ কখনো পাবে না। কারণ এ দেশে সে সংস্কৃতি গড়েই ওঠেনি। অথচ বিশ্বের যেকোনো সভ্য দেশে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে পার পেতো না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
জনগণ যদি একটু সচেতন হতো, নিজের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হতো তাহলে দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারতাম।
এ বছর বর্ষায় তেমন বৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ব্যাপারটি উদ্বেগজনক হলেও চট্টগ্রাম নগরবাসীর জন্য ব্যাপারটি ছিল আশির্বাদ স্বরূপ। কারণ যে ক’দিন সামান্য বৃষ্টি হয়েছে তাতেই তলিয়ে গেছে নগরের অনেক অংশ। কাজেই বর্ষায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে পুরো নগরই তলিয়ে যেত পানিতে। নগরে যত খাল আছে তার মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীনে (কাজ চলাকালীন পর্যন্ত) আছে প্রায় অর্ধেক খাল। বাকি অর্ধেক আগের মতোই সিটি করপোরেশনের অধীনে। চট্টগ্রামের দৈনিকগুলোতে এইসব খালের ছবি ছাপা হয় প্রায়। তাতে দেখা যায় সব খালই ভরাট হয়ে রাস্তার সমান অথবা তার চেয়েও উঁচু হয়ে গেছে। এই যদি পরিস্থিতি হয় তাহলে জলাবদ্ধতা না হয়ে উপায় কী! জলাবদ্ধতা নিয়ে, এই প্রকল্প নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এখন এ বিষয়ে কিছু বলবার তাগিদও বোধ করেন না কেউ। আসলে আমরা কেউ-ই জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে। অবশ্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বেশি জানার আগ্রহ থাকাও ভালো নয়।

লেখক : সাংবাদিক , কলামিস্ট