কর্ণফুলী পাড়ে চলছে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মহোৎসব

78

কর্ণফুলী পাড় থেকে চোখ যেন সরছেই না ভূমিদস্যুদের। কর্ণফুলী নদীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের রায় থাকলেও নেই বাস্তবায়ন। উপরন্তু, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করেও নির্মিত হচ্ছে আরও অবৈধ স্থাপনা। চলছে নতুন নতুন দালান নির্মাণের মহোৎসব।
জানা যায়, কর্ণফুলী শাহ আমানত (র.) সেতুর উত্তর দিকে বিসিএস আবাসিক এলাকার পর থেকে দুই কিলোমিটার এলাকাতে দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে চলে আসছে সরকারি খাস জমির দখল উৎসব। বাস্তুহারা নামের ওই এলাকায় সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতার পাশাপাশি ধনী ব্যবসায়ীর পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে চলছে দখল।
শুধু বাকলিয়ার বাস্তুহারা নয়, কর্ণফুলী ও চাক্তাই খালের পাশের খাস জমি গিলে খেয়েছে প্রভাবশালীরা। এর অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার ও কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ২০১০ সালে রিটটি দাখিল করেন। দফায় দফায় শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট কর্ণফুলী নদী পাড়ে গড়ে উঠা ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের রায় দেন হাইকোর্ট। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নতো দূরের কথা, নতুন করে গড়ে উঠছে দালান কোটা।
হাইকোর্টের সেই আদেশ বাস্তবায়ন না করার বিষয়টি রিটকারী আইনজীবী আদালতের নজরে আনলে গত বছর ২০১৮ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র, জেলা প্রশাসন, পুলিশ কমিশনার, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সিডিএ চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যানসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
সেই রুলের সপ্তাহ তিনেক পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন উল্লেখিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ২০১৮ সালের ২৮ জুলাই নোটিশ জারি করেন। ওই নোটিশে ৯০ দিনের মধ্যে নিজ দায়িত্বে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, অপসারণ বা ভেঙে ফেলার জন্য বলা হয়।
আদালতের রায় অনুসারে এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ বা ভেঙে দেওয়া না হলে প্রশাসন তা ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মালিকদের কাছ থেকে অপসারণের খরচ আদায় করা হবে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর শেষ হলেও এখনো উচ্ছেদ হয়নি অবৈধ এসব স্থাপনা। উপরন্তু বাকলিয়ার ক্ষেতচরে নতুন করে গড়ে উঠছে ইট-সুরকির স্থাপনা।
জেলা প্রশাসনের তালিকায় দেখা যায়, বাকলিয়া মৌজায় ৩৬৮টি এবং পূর্ব পতেঙ্গা মৌজায় ১৭৪৪টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। অবৈধ দখলদারদের তালিকায় রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ীর নামও। সবচেয়ে বেশি দখলদার রয়েছে বাকলিয়া এলাকায়। সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা থেকে দক্ষিণে নদীর সীমানা এবং ১৮৫ ফুট পর্যন্ত স্টেডিয়াম, স্টেডিয়ামের দক্ষিণে গড়ে উঠা খালি সেমিপাকা স্থাপনা, ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য তৈরি স্থাপনা, শুঁটকি মহাল, ক্ষেতচর এলাকায় কয়েকশ বাড়িঘর, পুকুর, মাছের খামার, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির। এছাড়া পূর্ব পতেঙ্গা এলাকাতে রয়েছে লালদিয়া জামে মসজিদ, লালদিয়া কবরস্থান, ঈদগাঁ ময়দান, প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাইক্লোন সেল্টার, লালদিয়া মসজিদ কলোনি, লালদিয়া চরের বেড়িবাঁধ ও পতেঙ্গা সড়ক এলাকায় রয়েছে হোটেল, চায়ের দোকান।
সরেজমিনে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই, রাজাখালী, বাকলিয়া এলাকায় বেশি দখল হয়েছে। বাস্তুহারা এলাকায় কয়েক হাজার বস্তিঘর রয়েছে। পাশাপাশি সরকারি এসব খাস জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে শুঁটকি আড়ত, মাছের খামার, মসজিদ, মন্দির, স্কুল, মাদ্রাসাসহ অসংখ্য স্থাপনা। বর্তমানে বাস্তুহারা সৎসঙ্গ আশ্রমের সাথে লাগোয়া প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে ছোট ছোট প্লটে দালান তৈরির মহোৎসব চলছে।
বছর দুয়েক থেকে চারিদিকে সীমানা দেওয়াল দিয়ে দখলে রাখা এসব জায়গাকে প্লট করে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে দেয় প্রভাবশালীরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল হওয়ার পর থেকে চক্রটি ওই জায়গায় পাকা দালান নির্মাণ শুরু করে।
সরেজমিনে গেলে নির্মাণ শ্রমিকরা কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক বলেন, এখানকার বেশিরভাগ প্লটে ৩ থেকে ৪ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দালান নির্মাণ করা হচ্ছে।
নতুন দখল ও স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে রিট আবেদনকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত একটি রায় দিয়েছেন। এখন আদালতের আদেশে উল্লেখ করা অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করতে হবে। জেলা প্রশাসন এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে নোটিশ জারি করেছেন। আশা করছি, এতে কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। তবে, উচ্চ আদালতের আদেশের বাইরেও নতুন কোন দখল কার্যক্রম চললে, আমরা তা আদালতের নজরে আনবো।’
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, ‘কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে আমরা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নোটিশ দিয়েছি। এসব নোটিশ পত্রিকায় প্রচারের জন্য অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন মাননীয় মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি চট্টগ্রামের হওয়ায় বরাদ্দ পেতে আমাদের সুবিধা হবে। আশা করছি, আমরা কর্ণফুলী নদীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সমর্থ হবো।’
তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী পাড়ের খাস জমিতে নতুন করে কোন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হলে, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা পদক্ষেপ নেবো।’