কর্ণফুলী টানেল-এর নামকরণ নিয়ে কিছু কথা

14

মিয়া জামশেদ উদ্দীন

বন্ধু নাসরাত হোসাইন। একটি প্রাইভেট কলেজে লেকচারার। অর্থাৎ তাহের-মঞ্জু কলেজে ছাত্র পড়ান। অপর ছোটভাই সাইফুর রহমান শাকিল, একটি মিডিয়াতে কর্মরত, অর্থাৎ সময় টিবির ক্যামেরাম্যান-পারসন। দুই জনই ওয়েল উইসার; সাম্প্রতি তাদের দুই জনের দুটি স্ট্যাটাস নজরে পড়ে। অবশ্য স্ট্যাটাস দুটি ছিল নামকরণ নিয়ে। যা অনেকের কাছে বেখাপ্পা এবং অতিরঞ্জিত মনে হয়। তারাও এই বিভ্রান্তি বা সংশয় দূর করতে চেষ্টা করেন। তবে, আমার দিকটাও ছিল ভিন্ন মর্মার্থ। নাম দিয়ে কি-বা আসে যায়। নামের সাথে ‘মিয়া’ যুক্ত হওয়ার কোন কারণই থাকতে পারে না। যা দৃষ্টিকটু ও অস্বাভাবিকতা ঠেকায়। হয়তো তারাও সেইভাবে দেখতে চায়নি; ফেবু বন্ধুদের পৃথক পৃথক কমেন্টে আরো নতুনমাত্রা যোগ হয়। ঘটনাটি যেভাবে সূত্রপাত: একদিন মামণি জেন প্রাঞ্জলা জয়া প্রশ্ন করে বসে। ‘আব্বু শোন, আমার নামের সাথে তোমার এবং আম্মুর নাম যুক্ত করেছ, কই তোমার নামের সাথে দাদুর নাম অর্থাৎ তোমার আব্বুর নামতো যুক্ত করোনি?’ হঠাৎ তার এমন প্রশ্নে হতচকিৎ। ভাবতে থাকি, কথাটিতো শতভাগই সত্য; রীতিমত শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ি; নাম নিয়ে এমন জবাবদিহিতা? এর মধ্যে অবলিলায় অর্ধশত বছর কেটে গেল, অর্থাৎ হাফ সেঞ্চুরী অতিক্রান্ত। যা কি-না বিষয়টি আবারো ঘুরেফিরে আসে। তবে দায়মুক্ত বলতে একটি কথা আছেÑ তারপরও এমন নয় যে, যেনতেনভাবে দায়ছাড়া প্রত্যুত্তর দেওয়া যায়? অবশ্য, তাকেও এসব নিয়ে বহুবার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়; প্রশ্নবান থেকে তার ক্ষোভ জাগানিয়া। এটিই বাস্তবতা। হয়তো একটা কিছু করা যেতোÑ গড্ডালিকা প্রবাহে গাঁ ভাসিয়ে দিলে তো, মন্দ হয় না; আম ছালা দু’য়ে রক্ষা পায়। যেইতু নতুন করে ডিজিটাল রেজিঃ হয়।
আবারও সুবর্ণ সুযোগটা আসেÑ হোক শরিয়াভিত্তিক নাম, তাহলে ফজিলতও বাড়বে। কিন্তু ওর মা সম্মতি দেয়নি। ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স, আর মাস্টারির উপর খবরদারী করা চলে না; এতবড় স্পর্ধা কার আছে? তারপরও সংশয় কাটে না। আমাদের সমাজ তো ঐ অবস্থায় উপনিত হয়নি, অর্থাৎ সমাজ গতানুগতিক অবস্থার বাহিরে না। তাই বলে কি অসহিষ্ণু বলতে পারি না? সমাজকে তো ওই পশ্চাদপদতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কোনোভাবে, কোন পন্থাই এগিয়ে যাবে, তা বলা মুশকিল। বার্লিনের প্রাচীরের মতো জগৎদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। তাই, নাম রাখাতে এত ডাকঢোল বা হিসাব-নিকাশ? কবি হাফিজ রশিদ খান অনেকটা একধাপ এগিয়ে প্রস্তাব দেয়Ñ অগ্রজদের উপদেশ সর্বদায় পাথেয়। সহজ-সরল, ‘প্রাঞ্জল’ থেকে প্রাঞ্জলা। মহান মুক্তিযুদ্ধের শৌর্য্য-বির্য্যের বিজয়ের মাসে জন্ম, তাই এই মর্মার্থে ‘জয়া’। আর মা নিগার সুলতানা এবং বাবার নামের প্রথম অক্ষরের সংযুক্তি ‘জেন’। ব্যাস, কঠিন এ সমিকরণে যা দাঁড়িয়েছে। অনেকের কাছে পুরো ব্যাখ্যাটা অস্পষ্ট বা বোধের জায়গা স্বচ্ছ নাও হতে পারে, বা অস্বস্তিকর-অস্বস্তিকর লাগতে পারে। সর্বশেষ তাঁর দাবিটা তো খাটো করে দেখতে পারি না, বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বলেকয়ে উড়ে ফেলে দিতে পারি না?
নিজের নামটাও সেইভাবে পরিবর্তন করা। বিশেষ করে তার দাবিকে অগ্রাধিকার দেয়া। অনেকটা ইচ্ছের প্রতিফলন হওয়া মানেই, তার আগ্রহ বাড়ানো এবং যুক্তিতর্কে একধাপ এগিয়ে নিয়ে, উৎসাহ দেয়া। বাবার নাম অর্থাৎ, তার দাদুর নাম ‘সেকান্দর মিয়া’। আবার বহুল পরিচিতিও ছিল কবিয়াল সেকান্দর মিয়া হিসেবে। অবশেষে নামের সাথে যুক্ত হয় ‘মিয়া’। নামের এই সংযুক্তি অনেকের কাছে সহনিয় ঠেকেনি; অবশ্য এক বন্ধুর ফেবুর স্ট্যাটাসে এভাবে প্রত্যুত্তর দিই। এটি ক্ষোভের বহিপ্রকাশ কিনা জানি নাÑ ‘মিয়ার পুত মিয়া’; অবশ্য, এটি একটি চাটগাঁইয়্যা গালি হিসেবে লোকেমুখে বহুল প্রচারিত প্রবাদবাক্য। চাটগাঁইয়্যারা দোকানে বসে বসে চা গিলে, আর ছাগলের মতো জাবর কেটে কেটে পানের রঙ্গরসে এসব বয়ান করেন। বাস্তবে এটি গালি না। মিয়ার ছেলে ‘মিয়া’ই হয়। ছাগলের ছানাতো আর হবে না? তবে নামের আহামরিতে বাহাদুরি করার কিছু নেই; জ্ঞানী-পÐিত না হয়ে, এসবে জারিজুরি ছাড়া আর কিছু নয়?
পদ্মাসেতু উদ্বোধন হয় ২৫ জুন ২০২২ ইং। পদ্মাসেতুর নামকরণ নিয়েও অহেতুক বিতর্ক জন্ম নেয় ক্ষণকাল। কিছু মানুষের বিরোধীতা আটার মতো লেগেই ছিল। পদ্মাসেতু উদ্বোধনীর দিনে সেটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়। টিকটক করতে গিয়ে পদ্মাসেতুর নাটবল্টু খোলে উল্লাস প্রকাশ করা! রীতিমত হাত উঁচিয়ে দেখাতে থাকে। অনেকে তো হাগুমুতু পর্যন্ত করেই ছাড়ে; কেউ কেউ আবার অধিক উৎসাহে দৃশ্য ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে জোরসে প্রচার চালায়। অনেককে নামাজ পড়তেও দেখা যায়। যার যা খুশি বলেকয়ে রঙ-তামাশা সাজানো, সবই হয়েছে। যে যাই বলুক না কেন, এসবে নিছক ছেলেমানুষির ঘটনার প্রতিফলিত হয়েছে। অথচ এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যা কি-না অর্থনীতির নতুন দিগন্ত সূচিত হয়েছে উত্তর জনপদে। এমনটিও বলা যায়, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এরপরও পজেটিভ চাইতে নেগেটিভ প্রচার-প্রভাকাÐ হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। অথচ সেতুর নির্মাণ নিয়ে যা-না অঘটন ঘটে।
টানা ২২-২৩ বছর ধরে এসব মুখরোচক গালগল্প চলতে থাকে। এসবে বরাবরই ক্ষমতাশীনরা ফেঁসে যায়। মন্ত্রী পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়। কয়েকজন আমলাকে তো জেলে যেতে হয়েছে। শেষ লড়াই আইনি, আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ পর্যন্ত হতে হলো। বলতে হয়, সেতু নির্মাণ অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিনিয়োগ, ঋণ বা সাহায্য, সবই প্রত্যাহার হয়। অর্থাৎ দাতা দেশগুলো মুখ ফিরে নেয়। এই অবস্থায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়। নিজেদের অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা হবে। অবশেষে তাই হলো। এই যেন ঘাত-প্রতিঘাতের অন্তর্জ¡ালা। সেই অধরা বা মাহেন্দ্রক্ষণ নাগালে আসে। স্বত্বি ফিরে পায় জাতিও। কিন্তু সেক্ষেত্রে নামকরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম যখন আসে, দেখাদেয় অযৌক্তিক নানা বিতর্ক। অর্থাৎ আমরা এখনো সহনীয় পর্যায়ে বা উদার মানসপটে পৌঁছাতে পারিনি। দৃষ্টান্ত নেই, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এমন স্থাপনাÑ যা অদ্বিতীয় এবং উন্নয়নের সর্বোচ্চ-শিখরে। এতসব দৃষ্টান্তের পরও বলতে হয়, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!’
প্রায় সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরেক মহাযজ্ঞ চলছে। একবাক্যে আধুনিকায়নের সোপান বলা যায়। বহুল প্রতীক্ষিত সেই কর্ণফুলী টানেল। নদীর ১৫০ফুট গভীর তলদেশে টানেলের নির্মাণ কাজ। যেটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াতে সর্বপ্রথম। যার দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কি.মি.। এ টানেল নির্মাণ কাজ শেষ হলে, চট্টগ্রাম সিটিসহ আনোয়ারার উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হবে। বিশেষ করে আনোয়ারা বন্দর থেকে ঢাকার দূরত্ব ৫০ কি.মি., কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫কি.মি. কমে আসবে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বে-টার্মিনালের সক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এটি মিরসরাইয়ে ইকোনোমিক জোন পর্যন্ত বিস্তৃত পাবে। এতে যুক্ত হবে মেরিনড্রাইভ। এককথায় চট্টগ্রাম সিটিকে ঢেলে সাজানো। যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নীতকরণ। দুর্বিষহ যানজট মুক্ত নগর জীবন। বৈর্জ্য-ময়লা অপসারণ। বিদ্যুৎ ও পানি নিরবিচ্ছিন্ন রাখা। সর্বোপুরি পরিবেশবান্ধব নগরি উপহার দেয়া। বলা যায়, যে অর্থে একটি আধুনিক বাণিজ্যিক নগরির পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে জনবান্ধব একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পিছিয়ে আছে যোগাযোগে ফৌজদারহাট টু- একেখান, অলঙ্কার, বন্দরলিংকরোড পর্যন্ত। অবশ্য লালখান বাজার থেকে ইয়ারপোর্ট পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন এমনটা অভিমত প্রকাশ করেন, চলতি বছর ২০২২ইং ডিসেম্বর, আগেই কর্ণফুলি টানেল নির্মাণ কাজ শেষ হবে। হয়তো তখন উদ্বোধনের সময়ক্ষণ এগিয়ে আনা হবে। কাজটি শুরু হয় ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ইং। তবে নামকরন নিয়ে কানাঘুষা যেমটা শুনা যাচ্ছেÑ এই ব্যাপারে এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার অভিমত জানতে চাইলে, তিনি ‘হ্যাঁ-না’ কোনপ্রকার উত্তর দিলেন না। অনেকটা নিরব-চুপচাপ থাকলেন।
তবে এইক্ষেত্রে আবশ্যকতা হলোÑ চট্টগ্রামে জাতির জনকের নামে একটি স্থাপনা থাকাটা অতিব প্রয়োজন এবং বীর প্রসবিনী তা একমাত্র ধারণ করতে পারে। এই চট্টলা, বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন-প্রীতিলতার চট্টলা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নামে এ টালেন নামকরন হলে চট্টলবাসীর মর্যাদাও বাড়বে। এটি হৃদগৌরবের বিষয়। তাতেও অনেকে ভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেÑএসবের কিসের প্রয়োজন; ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্ণফুলী টানেল।’ বিষয়টা অনেকটা উপ-আঞ্চলিক। বঙ্গবন্ধু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। এককথা তিনি জাতির জনক। এটি বাঙালিদের মণিকোটায় স্থান পেয়েছে। বিবিসির শ্রোতাদের এক জরিপে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নাম সর্বশীর্ষে স্থান পায়।
জাতির জনকের অবস্থান অনেকটা ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধি, মালয়েশিয়ার মাহাথির মুহাম্মদ, চিনের কমরেড মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো-চি মিন, আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা ল্যানসন ম্যান্ডেলা, কিউবার বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো, ফিলিস্তিনিদের নেতা ইয়াসিন আরাফাত, সোভিয়েত-রাশিয়ার ভøাদিমির লেলিন ও আমেরিকা গণতন্ত্রের জনক আব্রাহাম লিংকন।
ভারতের হাওড়া ব্রিজ নিয়েও এমন কথা আছে; ব্রিজটি কলকাতার হুগলি নদীর ওপর ১৮৭৪ সালে নির্মিত হয়। ১৯৪৫ সালে সেতুটির বহির্বাহু উদ্বোধন হয়। এর নির্মাণ শৈলীও অসাধারণ বলা যায়। প্রতিদিন গড়ে ৮০হাজার গাড়ি চলাচল করে। ১৯৬৫ সালে ব্রিজটি নামকরণে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে রাষ্ট্রটি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে ‘রবীন্দ্র সেতু’ রাখা হয়। কিন্তু সেতুটি নির্মাণে দীর্ঘ বছর অতিক্রম হলেও জনগণের অভ্যাস-আচারে তেমন একটা সাড়া মিলেনি। ঠিকেই সেই ‘হাওড়া ব্রিজ’ রয়ে গেল। হয়তো জনগণ সেই মানসে বিশ্বকবিকে দেখতে চাই না। সেক্ষেত্রে বিশ্ব কবির কি অমর্যাদা হয়েছে? বিশ্ব কবিকেতো তাঁর অমর সৃষ্টিশীল কর্মেই চিরঞ্জীব এবং সেই মানসপটে লালিত হয়ে আসছে বিশ্ববাসির কাছে। আর এসবের আলোকে বিষয়টি যথাযথ মর্যাদাকর হবে কিনা বিবেচ্যবিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও দাবি রাখতে পারিÑ হোক না জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নামে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক