কর্ণফুলী এখন বন্যহাতির গ্রাম

52

আবেদ আমিরী, কর্ণফুলী

চট্টগ্রাম নগরীর শহরতলী কর্ণফুলী উপজেলা এখন হাতির গ্রামে পরিণত হয়েছে। দুর্গম বনাঞ্চল ও পর্যাপ্ত চাষাবাদ এবং খাবার না থাকলেও হাতির পাল শহরতলীর এ উপজেলাকে স্থায়ী বসতি হিসেবে বেছে নিয়েছে। এসব হাতি আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারছে না কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দারা। দিনের বেলায় হাতির অবস্থান কেইপিজেড়ের জলাশয় ও বাগানে হলেও রাতে লোকালয়ে ঘর বাড়িতে হামলা চালায় খাবারের খোঁজে। প্রতিনিয়ত ঘটছে হতাহতের ঘটনা আর ধ্বংস করছে বাড়িঘর। সবশেষ গতকাল ভোরে হাতির আক্রমণে এয়ার মোহাম্মদ (৪৫) নামের একজন ইমাম আহত হয়েছেন। তিনি বড়উঠান খিলপাড়া গ্রামের খিলপাড়া মসজিদের ইমাম। ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার পথে তিনি হাতির সামনে পড়লে এ ঘটনা ঘটে। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, আগের দিন বুধবার ভোরে উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের কালা ফকির বাড়ি এলাকার কৃষক মোহাম্মদ এলাহী বক্স ও মোহাম্মদ আবছারের ঘর ভাঙচুর ও ফসল নষ্ট করে বন্যহাতি। সন্ধ্যা হলেই হানা দিচ্ছে বন্য হাতির দল। বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা হয়ে হাতির পাল প্রবেশ করে শহরতলী কর্ণফুলী উপজেলায়। গড়ে তুলেছে স্থায়ী বসতি।
জুলধা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য নুরুল হক জানান, বন্য হাতির কারণে সাধারণ মানুষ ভয়ের মধ্যে আছে। বড়উঠান ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াছ মেম্বার জানান, কখন কার ঘর এবং কোন গ্রামে হামলা চালাবে হাতি সে ভয় সর্বদা কাজ করে লোকজনের মাঝে। শান্তি নেই কর্ণফুলী উপজেলার বিশেষ করে বড়উঠান ও জুলধা ইউনিয়নের লোকজনের মাঝে
গত বছরের ১৩ মার্চ কর্ণফুলীতে হাতি পিষে মেরেছে ৩টি গরু। বড়উঠান ইউনিয়নের জাগিরপাড়া এলাকায় একদল হাতি আক্রমণ চালিয়ে মোহাম্মদ হানিফ বাবুর্চির এসব গরু পা দিয়ে পিষে হত্যা করে। এসব গরুর আনুমানিক মূল্য আড়াই লাখ টাকা। এদিকে কর্ণফুলীর লোকালয়ে বন্যহাতির তান্ডব থামাতে এবং ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উদ্যোগ নিয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ। তারা হাতি তাড়ানোর কৌশল শেখাচ্ছে স্থানীয়দের।
সহকারী বন সংরক্ষক ও রেঞ্জ কর্মকর্তা রিটা আক্তার জানান, খাবারের খোঁজে লোকালয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে হাতি। কিন্তু এদের তাড়াতে পারছি না। তিনি জানান, সরকার নতুন একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে বনাঞ্চলকে পরিপূর্ণ করা হবে। বনাঞ্চল পরিপূর্ণ হলে হাতি লোকালয়ে আর থাকবে না। তিনি বলেন, কর্ণফুলী প্রতিনিয়ত হাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটছে এবং এ সংক্রান্তে ১০-১৫টি ক্ষতি পূরণের ফাইল তার দপ্তরে জমা হয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক চৌধুরী তার ফেসবুক পেইজ থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেছেন, ভৌগোলিক অবস্থান হিসাবে কর্ণফুলী উপজেলায় বন্যপ্রাণির আবাসস্থল ছিল না। জাতির পিতার হাতে গড়া সংবিধানে জনগণ এবং জনগণের সম্পদ ধ্বংস করে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের কথা বলা হয় নি।আমাদের মন্ত্রী সাইফুজ্জমান চৌধুরী জাবেদ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সাথে কথা বলে সুরাহা না হওয়াতে কেবিনেটেও এই ব্যাপারটি উত্থাপন করেছিলেন। এই পর্যন্ত কত জীবন গেল বন্যহাতির আক্রমণে, কত সম্পদ ধ্বংস হল, কত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করল, কত ফসলের ক্ষতি সাধন করল, কত রাত অনিদ্রার মধ্যে পার করল, আর এলাকার জনগণকে বন্যহাতির আক্রমণ থেকে বাঁচানোর করুন আর্তনাদ, আবেদন, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সেটা প্রতিনিয়ত অসহায়ত্বের ধুম্রজালে বন্দি।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, হাতি ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়ায় কর্ণফুলীতে হাতি স্থায়ী বসতি গড়েছে। হাতি এমন কোন প্রাণি নয় যে, জোর করে বের করে দেয়া যাবে।
তিনি বলেন, হাতি যে পথ দিয়ে প্রবেশ করে সে পথ দিয়ে আবার বনাঞ্চলে ফিরে যায়। কিন্তু কর্ণফুলীতে স্থায়ী বসতি গড়া হাতিগুলো প্রবেশ করার পর হয়ত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সে পথে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এর ফলে হাতিগুলো পথ হারিয়ে কর্ণফুলী ও আশেপাশে বসতি গড়েছে। কর্ণফুলী ও আশপাশের উপজেলায় হাতির জন্য পর্যাপ্ত বনাঞ্চল ও খাবার নেই। তা সত্তে¡ও হাতিগুলো পথ খুঁজে না পেয়ে সেখানে অবস্থান করছে আর পেটের দায়ে ঘরবাড়িতে হামলা ও লোকজনকে মারছে। ছোট একটি উপজেলায় হাতিগুলোকে তাড়িয়ে লোকজন কোথায় নিয়ে যাবে, চারপাশেই তো বসতি।
হাতিগুলোকে বের করে দেয়ার কোন উপায় কি নেই এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এভাবে কখানো ভেবে দেখা হয় নি। দেখি কিভাবে কি করা যায়।