কর্ণফুলীর প্রস্থ কমেছে ৫০০ মিটার শাহ আমানত সেতু ‘ঝুঁকিতে’

53

নিজস্ব প্রতিবেদক

কর্ণফুলী নদী নিয়ে ব্যক্তি ও সংস্থা রীতিমত ব্যবসায় মেতেছে। অবৈধ দখল ও দূষণের দাপটে জীবন্ত কর্ণফুলী মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে ক্রমাগত। গত ২২ বছরে বিলীন হয়েছে গেছে কর্ণফুলী নদীর (প্রস্থ) প্রায় ৫০০ মিটার এলাকা। সেই সঙ্গে উজানের ঢলে একপাশে গভীরতা বাড়ায় শাহ আমানত সেতু হুমকির মুখে পড়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে ‘কর্ণফুলী নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন। গতকাল রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশের গভীরতা ও দখল জরিপ ২০২২’ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করা হল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৯৩০.৩১ মিটার। কিন্তু বর্তমানে প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪১০ মিটার। গত ২২ বছরে বিলীন হয়ে গেছে নদীর প্রায় ৫০০ মিটার এলাকা। এছাড়া একপাশে চর ও অন্যপাশে ক্রমশ মাটি সরে যাওয়ায় শাহ আমানত ব্রিজের দক্ষিণ পাশ ধসে যেতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। কর্ণফুলী নদীর তলদেশের বাস্তব পরিস্থিতি ও দখল নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয় চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। জরিপ কাজ পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও রোড কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ ড. স্বপন কুমার পালিত, কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী ও মেরিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নোমান আহমদ সিদ্দিকি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ম্যানুয়াল ও ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর তলদেশের গভীরতা পরিমাপ করা হয়। এতে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ চর পাথরঘাটা ব্রিজঘাট এলাকায় ২৫ ফুট, মাঝ নদী বরাবর ৩৮ ফুট, উত্তর পাশে ফিরিঙ্গিবাজার ব্রিজঘাট এলাকায় ২৪ ফুট। এই এলাকাটি নিয়মিত ড্রেজিং করায় নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ রয়েছে। কিন্তু এর ঠিক ৫০০ মিটার উজানে চাক্তাই খালের মোহনায় উত্তর পাশে কর্ণফুলীর প্রকৃত সীমানা থেকে তিনশ ফুট নদীর অংশে গভীরতা মাত্র ২ ফুট, মাঝ নদী বরাবর ১৩.৬ ফুট এবং দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট। তাছাড়া নদীর আরও ৫০০ ফুট উজানে উত্তর পাশে রাজাখালী খালের মোহনায় মাঝ নদীতে গভীরতা মাত্র ৪ ফুট। কিন্তু শাহ আমানত সেতুর তিন নম্বর পিলার বরাবর নদীর গভীরতা ৬০.৯ ফুট।
জরিপে আরও দেখানো হয়, কর্ণফুলী সেতুর উত্তর পাশে ১ ও ২ নম্বর পিলারের মধ্যখানে গভীরতা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার পরিমাপ অনুযায়ী ২৫ ফুট থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমান গভীরতা হচ্ছে মাত্র ৭.৭ ফুট। এছাড়া ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মধ্যখানে গভীরতা থাকার কথা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার গভীরতা অনুযায়ী ৩৮ ফুট। বাস্তবে এই দুই পিলারের মধ্যখানে চর জেগেছে। আবার সেতুর ৩ ও ৪ নম্বর পিলার এলাকায় স্বাভাবিক গভীরতা ৩৮ ফুট থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমান গভীরতা বেড়ে ৬৪.৭ ফুট এবং সেতুর দক্ষিণ তীরে ৪ ও ৫ নম্বর পিলারে নদীর স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট। কিন্তু সেখানে গভীরতা ৭৮.৬ ফুট।
শীঘ্রই নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রয়োজন জানিয়ে পরিবেশবিদ, সাংবাদিক আলীউর রহমান বলেন, প্রথমত নদীর দুইপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে গত ২০ বছরে যা ভরাট হয়েছে তা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এছাড়া নদীর দূষণ রোধে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে।
কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, সময় থাকতে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। নদীতে যে হারে পলি জমছে এবং শহরের আবর্জনা পড়ছে তা রোধ করা না গেলে একসময় কর্ণফুলী মরা নদীতে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, জোয়ারের সময় বুঝা না গেলেও ভাটার সময় বুঝা যায়, নদীর বাস্তব পরিস্থিতি। কিন্তু এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ কর্ণপাত করছে না। আমাদের কাজ সচেতন করা। আমরা তা-ই করছি। কিন্তু যাদের কাজ করা দরকার তাদের কাজ করতে হবে। এতেই নদী বাঁচবে দেশ বাঁচবে। কর্ণফুলী নদীকে নিয়ে ব্যক্তি ও সংস্থার তরফে রীতিমত ব্যবসা চলছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মেরিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নোমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাশ, অধ্যাপক জনার্দন বণিক, অ্যাডভোকেট সেলিম চৌধুরী, এস এম পেয়ার আলী, জাফর আহমদ প্রমুখ।
এদিকে শাহ আমানত সেতুর হুমকির মুখে পড়ার বিষয়ে সেতু নির্মাণকারী সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই পিলারের নিচ থেকে মাটি কিছুটা সরলেও এখনও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
এই বিষয়ে চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত বলেন, ‘সেতুর চার ও পাঁচ নম্বর পিলার ঝুঁকির মধ্যে আছে। মাটি সরে যাচ্ছে। পিলারের নিচ থেকে পানির তোড়ে মাটি ভেসে যাচ্ছে, কারণ সেখানে গভীরতা বেশি। এর কারণ হচ্ছে, উত্তর দিক থেকে অর্থাৎ শহরের দিক থেকে নদী ভরাট হয়ে গেছে। চাক্তাই খাল ও রাজাখালী খাল দিয়ে আসা বর্জ্য ও পলি জমে নদী ভরাট হয়ে গেছে। শাহ আমানত সেতুর প্রায় অর্ধেক অংশে চর পড়ে গেছে। এই চর পড়ার ফলে নদীর উজান থেকে আসা স্রোত দক্ষিণে বেশি হয়ে গেছে। ফলে মাটি ক্ষয় হচ্ছে, সরে যাচ্ছে। এতে মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে’। ‘এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে শিকলবাহা খালের স্রোত। এই স্রোতে মাটি ভেসে যাচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে চার ও পাঁচ নম্বর পিলারের ধারণশক্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকবে। পিলার দু’টি আস্তে আস্তে দেবে যেতে থাকবে। এজন্যই সেতুটা ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। তবে এটা আরও ডিটেইলস ইনভেস্টিগেশনের প্রয়োজন আছে, বলেন অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত।
এই বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা জানান, ‘পিলারের নিচ থেকে ৬০-৭০ ফুট, এমনকি ১০০ ফুট মাটিও যদি সরে যায়, তবু সেতু ঝুঁকির মধ্যে পড়বে না। পানির তলদেশ থেকে সেতুর পিলারের ভিত্তি ২৫০ ফুট গভীরে। সুতরাং মাটি সরে যাওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরির যে বিষয় বলা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়। আমি জানি না, যারা জরিপ করেছেন উনারা সেতুর নকশাটা দেখেছেন কি না। উনাদের উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে কথা বলা। কোনো বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন না হলে তো শুধু আতঙ্ক ছড়াবে, আর কিছু হবে না।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সেতু) জামাল উদ্দিন জানান, ‘ব্রিজ এক্সপার্টরা আছেন। আমরা উনাদের মতামত নেব। যদি সত্যিই কোনো সমস্যা হয়, তাহলে সেটা সমাধান করা হবে।’
একদিকে নদী ভরাট, আবার তলদেশ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় এর সমাধানে দ্রুত খননের ওপরই সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন গবেষক স্বপন কুমার পালিত।
তিনি আরও জানান, ‘নদী দ্রুত ড্রেজিং করে পলিথিন ও পলি তুলে ফেলতে হবে। এতে নাব্যতা বাড়বে। স্রোত ডাইভার্ট হয়ে যাবে। যেখানে গভীরতা বেশি, সেখানে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাবে। তাহলে সেতু নিয়ে ঝুঁকি আর থাকবে না।’
এদিকে খনন কাজে নিয়োজিতদের দূষছেন রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ড্রেজিংয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে নৌবাহিনীকে। তারা যুক্ত করল নৌকল্যাণ সংস্থাকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাইফ পাওয়ার টেক। এদের কারও তো ড্রেজিংয়ের অভিজ্ঞতা নেই। কর্ণফুলী নদী নিয়ে চলছে ব্যবসা।