করোনা মুক্ত সুস্থ জীবন প্রত্যাশায় ‘মেডিটেশন’

105

মেডিটেশন শরীরের ইমিউন শক্তি বাড়িয়ে দেয়। ফলে মেডিটেশন করোনা বা যে কোন ভাইরাস প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা শক্তি হিসেবে কাজ করে। মেডিটেশন মানে ধ্যান বা মোরাকাবা। ধ্যানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেহের রোগ নিরাময়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মেধার বিকাশ ও অতেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে জাগ্রত করা যায়। মেডিটেশন বা ধ্যান কথাটির মধ্যে একটি ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে। এর সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা সভ্্যতার উষালগ্ন হতে হলেও প্রাচীন সাধক, দরবেশ ও মুনী-ঋষিদের মধ্যে এর চর্চা সীমিত ছিল। মূলত: মেডিটেশন হচ্ছে দম চর্চা অর্থাৎ মানবদেহের অভ্যন্তরীণ শরীরচর্চা ও মনের ব্যায়াম। দম চর্চার মাধ্যমে পেশী ও ¯œায়ুকে শিথিল করে আত্মনিমগ্ন হওয়া। প্রকৃতি হতে এ দম আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে থাকি বলে এটাকে হালকা মনে করার কেন সুযোগ নেই। এদমই আমাদের জীবনের মূল চালিকাশক্তি। মেডিটেশনে দমের সুশৃঙ্খল প্রবাহে দেহমন শিথিল হয়, মনের স্ট্রেস বা চাপ কমে, দেহকোষ সতেজ হয়ে রোগ নিরাময়ে মনে দৈহিক প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল হয়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
ইমিউন শব্দটির অর্থ – প্রতিরক্ষা। মানুষের দেহে ইমিউন সিস্টেম নামক খুব সংবেদনশীল এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা পদ্ধতি খুবই ত্বরিত গতিতে করোনা সহ প্রায় সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া,ভাইরাস এবং অন্যান্য জীবাণুকে সনাক্ত করতে এবং ধ্বংস করে দিতে পারে। কোন কারণে যখন এ ইমিউন সিস্টেম ব্যর্থ হয় কেবল মাত্র তখনই শরীর জীবাণু দ্বারা রোগাক্রান্ত হতে পারে। ইমিউন সিস্টেম কাজ করে দুটি – জীবাণু বা বহিঃশ্ত্রু কে সনাক্ত করা আর ধ্বংস করা। রক্তের শ্বেত কণিকা এর মাধ্যমেই এ কাজটি সম্পাদিত হয়। মূলত: ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শ্বেতকনিকা এ সনাক্তকরণ এবং ধ্বংস করার কাজে ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় এক ধরনের কণিকাই দুটি কাজ সম্পাদন করে থাকে। যখন কোন শ্বেতকনিকা একটি জীবাণু বা বহিঃশত্রুকে সনাক্ত করতে পারে সাথে সাথে এটি অন্যান্য শ্বেত কনিকাদের কাছে সংকেত পাঠিয়ে দেয়। এ সংকেত পেয়ে অসংখ্য নতুন ধরনের শ্বেত কণিকা জীবাণুর চারপাশে চলে আসে। এই সংকেতের তীব্রতার উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নতুন শ্বেত কনিকা যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাত্রা শুরু করে। যুদ্ধক্ষেত্রে আগন্তুক এ’ কনিকারা কেউ কেউ জীবাণু কে ঘিরে ফেলে, কেউ কেউ তাকে একদম শেষ করে দিতে বেশ পারদর্শী। এদের কেউ কেউ আবার ঐ জাতীয় সকল জীবাণু যেখানেই থাকুক না কেন তাকে খুঁজে বের করে শেষ করে দেয়। এটাই শেষ কথা নয়, শ্বেত কণিকার মধ্যে তীক্ষè স্মরণশক্তিসম্পন্ন একটি বিশেষ উপদল ঐ ধরনের জীবাণুগুলোকে সারা জীবনের জন্য চিনে রাখে। পরবর্তীতে কখনও যদি শরীর আবার আক্রান্ত হয় এ বিশেষ দলটির তত্ত¡াবধানে শ্বেত কনিকাগুলো নিমিষেই সেই জীবাণুকে ধ্বংস করে দেয়। তাছাড়া মানুষের শরীরে বিদ্যমান রয়েছে রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান গামা ইন্টারফেরন ও টি-সেল কার্যকারিতা। এতে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। আবার স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে ক্যান্সারের ন্যায় ভয়াবহ সেল যা শরীরের কোন ক্ষতিকর প্রভাবের পূর্বেই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ন্যাচারাল কিলার সেল সেই ভয়ংকর সেলগুলিকে ধ্বংস করে। শরীরের এ অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রিয়াশীল রাখার জন্য মেডিটেশনের ভূমিকা সর্বাধিক। মেডিটেশনের মাধ্যমে শরীরবৃত্তীয় কর্যাদি নিয়ন্ত্রণে রেখে শৃঙ্খলার সাথে দৈনন্দিন জীবন যাপনে শরীর সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখা সম্ভব।
শরীরকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখতে রক্তে অক্সিজেন সরবরাহের গুরুত্ব অপরিসীম। আর শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহে প্রয়োজন যথার্থ দমচর্চা অর্থাৎ মেডিটেশন। আমাদের এক একটি পূর্ণ দম শরীরে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। একবার দম নেয়ার সাথে শরীরেরর পাঁচ ট্রিলিয়ন রক্তকণিকা বাতাসের মুখোমুখি হয়। প্রতিটি রক্তকণিকায় রয়েছে দুই শত আশি মিলিয়ন হিমোগেøাবিন অণু। আর প্রতিটি হিমোগেøাবিন অণু আটটি করে অক্সিজেন পরমাণু ধরতে ও পরিবহন করতে পারে। প্রতিটি দমের সাথে এগার এর পাশে একুশটা শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয় সে পরিমাণ অক্সিজেন পরমাণু শরীরে প্রবেশ করে। আমাদের জীবকোষের মূল খাবার হচ্ছে অক্সিজেন। এ অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে জীবকোষে পৌঁছে। ফলে রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্বেতরক্তকণিকার কার্যকারিতা বাড়ে ও অক্সিজেন এর সংস্পর্শে জীবকোষ উদ্দীপিত হওয়ায় শরীরবৃত্তীয় প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। ইমিউন সিস্টেম যত শক্তিশালী হবে রোগ বা অসুস্থতার ঝুঁকি তত কমে যাবে। লাইফ স্টাইলের অসংগতি বা বিশৃংখলা এ সিস্টেমকে দুর্বল করতে পারে বা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা কমিয়ে ফেলতে পারে। তাই ইমিউন সিস্টেমকে সর্বোচ্চ কার্যকর রাখতে সুশৃংখল দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘসময় ধরে অতিরিক্ত স্ট্রেসে থাকলে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই স্ট্রেস কমিয়ে আনন্দ অনুভবের মাধ্যমে নিজেকে শিথিল করতে হবে। ইতিবাচক বা ভালো চিন্তাভাবনা ইমিউন সিস্টেমকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। মন আনন্দে থাকলে ও হাসলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং ইমিউন সিস্টেম আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আবার ইমিউন সিস্টেমকে সবল রাখতে নিয়মিত শরীরকে সচল রাখা জরুরি আর এর জন্য প্রয়োজন নিয়মিত শরীরচর্চা বা এক্সারসাইজ করা। নিয়মিত এক্সারসাইজে মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। এতে ঘুম ভাল হয়। পর্যাপ্ত ঘুম ছাড়া ইমিউন সিস্টেম রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি পাবে না। অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক লোকের প্রতিরাতে সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন হয়। নিয়মিত ঘুমের শিডিউল মেনে চলে, ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থেকে বিছানায় যাওয়ার আগে শরীরকে শিথিল করে নিরবচ্ছিন্ন গভীর ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত মেডিটেশনের মাধ্যমে মানসিক সেট্রস নিয়ন্ত্রণ, মনে প্রশান্তি সৃষ্টি, মন ও দেহে শিথিলায়নের মাধ্যমে গভীর ঘুম ও অন্যান্য ইতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অপরদিকে, মানব শরীরে ইমিউন শক্তি বৃদ্ধিতে ডায়েটের বিষয়েও যতœশীল হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট পেতে বিভিন্ন রঙের ফল ও শাকসবজি যেমন- কমলা, কাঁচা মরিচ, স্ট্রবেরি, গাজর, তরমুজ, পেঁপে, খরমুজ ও সবুজ শাকসবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের স্বাস্থ্যকর উপাদান পাওয়া যায়। খাবারের এসব উপাদান মানব কোষকে ফ্রি র‌্যাডিকেলস্ থেকে রক্ষা করতে পারে। ইমিউন সিস্টেমকে রোগের বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য অন্যতম সহজ উপায় হচ্ছে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস। এটি ভাইরাস হতে সুস্থ থাকার সেরা উপায়। সাবান ব্যবহার করে পরিষ্কার পানিতে হাত ধোয়া অথবা সাবান ও পানি না থাকলে অ্যালকোহল-বেসড হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেখানে প্রয়োজনীয় পরিমান অ্যালকোহল রয়েছে। খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে, বাথরুম ব্যবহারের পরে ও জীবাণু থাকতে পারে এমন কিছুর সংস্পর্শে আসলে হাত ধুয়ে নেয়া অত্যন্ত জরুরি।
মেডিটেশন বা ধ্যানে বা মোরাকাবায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ সংঘটিত হয়। এতে দেহ ও মন শিথিল হয় এবং শরীরের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে মনোদৈহিক প্রক্রিয়ায় করোনা ভাইরাস মোকাবেলা সহজ হয়। তাছাড়া নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও সবার থেকে নিরাপদ বিচ্ছিন্ন রেখে সুরক্ষিত থাকা যায়। এখন সকলের সব ধরনের কর্মব্যস্ততা স্থগিত, ফলে আমরা প্রত্যেকেই অলস সময় কাটাচ্ছি। তাই অনুরোধ, করোনা মুক্ত সুস্থ জীবন প্রত্যাশায় চলুন দিনে অন্তত দুই বার ঘরে বসে মেডিটেশন বা ধ্যান করি। মনোদৈহিক প্রক্রিয়ায় ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে শরীরে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করি। আতঙ্ক নয়, সচেতনতা ও সুস্থ জীবন চর্চাই করোনা প্রতিরোধের হাতিয়ার।

লেখক : ডিজিএম, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড