করোনা মহামারিতে এল অন্যরকম এক ঈদ

174

‘ঈদের সালাম নিও, দোয়া করো আগামি বছর/কাটিয়ে উঠতে পারি যেন এই তিক্ত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা।/ অন্ততঃ ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি,/একটি পাঞ্জাবী আর সাদা গোলটুপি তোমাকে পাঠাতে যেন পারি;/আর দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা’।
কবি সিকান্দর আবু জাফরের ‘ঈদের চিঠি’ থেকে উদ্ধৃত একয়েক ছত্রই আজ বড় প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। আজ জাতীয় কবি নজরুলের সেই চিরায়ত ঈদের গানখানা- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে/এল খুশির ঈদ,/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে/ শোন আসমানী তাগিদ’ প্রাসঙ্গিকতা যেন দুর্যোগের ত্রাহিতে ¤øান হয়ে গেছে। কারণ আজ চাঁদ উঠবে তাই ঘরের ছাদে, পুকুরের পাড়ে স্বচ্ছ জলে চোখ দুখানা ভিজিয়ে কিংবা আকাশের পানে হাত উচিয়ে ‘ঐ যে চাঁদ উঠেছে-এমন হৈ হুল্লুড়’ অন্তত এবার আর কোনো দূরন্ত কিশোর কিংবা শিশু করবে না। কারণ তারাও জেনে গেছে, এবারের ঈদ ¤øান হয়ে গেছে কোভিড-১৯ এর করুণ ছোবলে। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সুপার সাইক্লোন আম্ফান। এসব বিবেচনায় বলা যায়, মুমূর্ষ বদনে আজ ঈদ এসেছে, তাকে বরণে নেই কোনো সাজ, নেই কোনো গান, নেই কোনো ডাকঢোল। আছে ভয়, মানুষেরই ভয়। যদি গায়ের সাথে গা লাগে তাহলে করোনার লাগতে পারে ছোঁয়া। তাই আমরা এবার বর্জন করেছি ঈদের বাজার, বাজারের সওদাগররাও সওদা করেননি এবার। বাঁচার তাগিদে, জীবনের তাগিদে হাজার কোটি টাকার লাভের ধন দোকানের তাকে রেখেই আজ আমরা ঈদের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিন ফুট দূরত্ব থেকে আজ আমরা চাঁদ দেখব, চাঁদ দেখা গেলেই কাল হবে আমাদের ঈদ, নেহায়েত পরশু বা সোমবার উদ্যাপিত হবে ঈদ উল ফিতর।
এবারের ঈদ সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিবেশে যেমন এসেছে, উদ্যাপিতও হবে ভিন্নভাবে। এবার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার কর্তৃক দীর্ঘ দুইমাস সাধারণ ছুটি ও স্থান বিশেষে লকডাউনের পর ঈদকে কেন্দ্র করে শর্তসাপেক্ষে সীমিত আকারে মার্কেট ও শপিং মল খোলা রাখার উদ্যোগ নিলেও সরকারের বেঁধে দেয়া শর্ত মানতে অপরাগতা প্রকাশ করে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের সকল বিভাগীয় শহরের অধিকাংশ শপিং মল ও দোকানপাট বন্ধ ছিল। ফলে সাধারণ মানুষ ঈদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেননি, এরপরও সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ স্থান ত্যাগ করার উপর বিধিনিষেধ জারি হওয়ায় শহরের মানুষ গ্রামে যাওয়াও অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে উন্মুক্ত ময়দানে ঈদের নামাজ না পড়ার আহবান জানিয়েছে সরকার।
এ প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিনের রেওয়াজ ভেঙে সীমিত ও শর্তসাপেক্ষে এবার ঈদের নামাজও হবে মসজিদে। সবমিলিয়ে যাপিত জীবনের নানা বাঁকে এ ঘাত-প্রতিঘাতগুলো মেনেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের তাবৎ মুসলিম আজ বা কাল অথবা পরশু ঈদ উদ্যাপন করবে।
চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ঈদের প্রধান জামাত বরাবরের মতোই হবে নগরীর দামপাড়াস্থ জমিয়তুল ফালাহ্ মসজিদে। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঈদ জামাত সরকারের শর্ত মেনে মসজিদের ভেতরেই হবে। প্রথম জামাত হবে সকাল সাড়ে আটটায়। দ্বিতীয় জামাত হবে ৮টা ৪৫ মিনিটে। কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত প্রতিবছর স্টেডিয়ামে আয়োজন থাকলেও এবার তা হচ্ছে না। দ্বিতীয় বৃহত্তর জামাত হতে পারে নগরীর আন্দকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। এছাড়া নগরীর উন্মুক্ত ময়দান বাদ দিয়ে সকল ঈদ জামাত মসজিদে আয়োজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন অনুরোধ জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চাওয়া হলে তারও ব্যবস্থা করা হবে বলেও তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
এদিকে পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন। দেশের সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ ব্যাপক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ঈদের সার্বজনীনতার মধ্যে যে নির্মল খুশীর আবেদন রয়েছে তা এবার কিছুটা ¤øান হলেও আমরা বিশ্বাস করি, অন্ধকার ঘুছিয়ে একদিন আলো আসবে। দেশবাসী ঠিক আগের মতই ঈদের আনন্দে মাতবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জীবনেই উৎসব রয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ উৎসব পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠি-ধর্মের উৎসবের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ইসলাম প্রবর্তিত আনন্দ-উৎসব ইহকালীন ও পরকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলমানদের ঈদ নিছক উৎসবই নয় বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। এটিই ইসলামের সৌন্দর্য। মুসলমানদের ঈদের ইহকালীন তাৎপর্য হলো, রমজান শেষে সাদাকাতুল ফিতর দিয়ে অসহায়-গরীবদের আর্থিক সহায়তার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। অস্বচ্ছল পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে দুু’টি ঈদ যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। সঙ্গতকারণে এবার এ বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা আরো অধিক।
ঈদের পরকালীন তাৎপর্য হলো- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজান মাসকে বিভিন্ন ধরনের নিয়ামতে ভরপুর করেছেন। এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে। দিনে রোজা রাখার এবং রাত্রিকালীন ইবাদতের মধ্যে অনেক ফযীলতের কথা বিবৃত হয়েছে। লাইলাতুল কদর নামক হাজার রাতেরও চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি মহিমান্বিত রাত দান করা হয়েছে এ মাসে। পাপ মোচনের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ এসে যায় রমজান মাসে। এ সমস্ত নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থা। কাজেই ঈদ নিছক আনন্দ উৎসব নয়, এটি একটি ফযীলতপূর্ণ ইবাদত এবং সে কারণেই ঈদের রাতে এবং ঈদের দিনের অনেক ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে হাদীসে।