করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় প্রয়োজন জাতীয় কৌশলপত্র

59

নোমান উল্লাহ বাহার

পৃথিবীতে নানাবিধ রোগব্যাধির উৎস নির্মূলপূর্বক চিকিৎসা ক্ষেত্রে মানুষ যখন সফলতার উচ্চতায় এবং স্বাস্থ্যসেবার কাক্সিক্ষত মান অর্জনে প্রাগ্রসর, ঠিক তখনি করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)’র উপদ্রব বয়ে এনেছে এক মহাসংকট। প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত অন্যান্য ভাইরাস হতে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ভয়ানক ছোঁয়াচে কোভিড-১৯ দ্রুততম সময়ে দেশ হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীব্যাপী অদৃশ্য এই শক্তি জ্যামিতিক হারে ছড়াচ্ছে। একজন অথবা অল্পসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে, সেখানে মানুষের অজান্তেই অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজারের অধিক ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত চার লক্ষাধিক মানুষ (২৭মার্চ ২০২০ পর্যন্ত)। প্রায় ১৯৯টির দেশে সংক্রমিত হয়েছে। ১৫০টির বেশি দেশ আংশিক কিংবা পূর্ণভাবে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। আকাশপথ ও সড়ক পথও থমকে গেছে। এই মহামারী শুধুমাত্র স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপর্যয় আনেনি বরং মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহ ও সামষ্ঠিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। বৈশ্বিক পর্যটন, উৎপাদন, সেবা ও আর্থিক খাত ভেঙ্গে পড়েছে। চলমান বৈশ্বিক সংকটটি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ঐকান্তিক সক্রিয়তায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমন্বিত উদ্যোগ, অর্থায়ন, অভিজ্ঞতা বিনিময়সহ কার্যকর পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে সুরক্ষিত হতে উন্নত দেশসমূহ হিমশিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিদেশ ফেরত সংক্রমিত ব্যক্তি/ব্যক্তিদের মাধ্যমে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশেও বিস্তৃত হয়ে চরম ঝুঁকিতে নিপতিত। পূর্ব প্রস্তুতিতে ঘাটতি, জনসংখ্যার অনুপাত, নাগরিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতা, কার্যকর স্ক্রিনিং এর সংকট, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে থাকাসহ সার্বিক বিবেচনায় করোনা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা অপ্রতুল। দোষারোপের সংস্কৃতি, কুসংস্কার, ভুল ধারণা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসত্য তথ্যের ছড়াছড়ি, অভিযোগ প্রভৃতি নেতিবাচক চিন্তা ও কার্যকলাপ থেকে মুক্ত থেকে জনমনে সাহস সঞ্চারণপূর্বক আমাদের সচেতনতা, সত্য সংবাদমুখী হওয়া, সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষণ ও সতকর্তা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এরই মধ্যে ৫জন মৃত্যুবরণ করেছে এবং আক্রান্ত হয়েছে ৪৮ জন (২৭মার্চ ২০২০ পর্যন্ত)। কালক্ষেপণ না করে করোনা থেকে যে সকল দেশ মুক্ত সে সকল দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবং তাদের দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী, গবেষণা, উপকরণ সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশকে এগুতে হবে। বিশেষত স্বাস্থ্যসেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী, মাঠ প্রশাসন কর্মী, সাংবাদিক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সংক্রমণমুক্তি নিশ্চিতে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) প্রদানের লক্ষ্যে সংগ্রহ ও সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরী। অতিমাত্রায় সংক্রামক করোনা রোগীদের পরীক্ষাগুলো সাশ্রয়ী, ব্যাপকভাবে করার পর্যাপ্ত উদ্যোগ সর্বোপরি শনাক্ত ও পৃথক করাকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। সরকারের সক্রিয়তার পাশাপাশি নাগরিকদের সর্বোচ্চ সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে সংক্রমণ রোধ সম্ভবপর হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যান্য শিষ্টাচার কঠোরভাবে অনুশীলন ও মেনে চলার উপর সকলের মনোনিবেশ সমভাবে জরুরী। আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক বদভ্যাস যেমন- যেখানে সেখানে থু থু নিক্ষেপ, গুজব-আতঙ্ক ছড়ানো, সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলা, পানের পিক ফেলা, ময়লা ফেলা প্রভৃতি দূরীকরণ এবং সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া, হাঁচি-কাশি দিতে হাত নয়-কনুই ব্যবহার করা, পরিবেশ সুস্থ রাখা, শারীরিক ব্যায়াম করা, নিজ ঘরে থেকে বই পড়া, সংগীত শোনা, সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকার মত ইতিবাচক অভ্যাসমূহের চর্চা বাড়াতে হবে। করোনার সংক্রমণ সংকুচিত করতে করমর্দন না করা, টাকাসহ বহুল জনব্যবহৃত দ্রব্যাদি থেকে সতর্কতা অবলম্বন, কর্মক্ষেত্রে না গিয়ে নিজ গৃহে কাজ করা, অনলাইনে কেনাকাটা, জীবানুমুক্ত থাকার উপর আমাদের সচেষ্ট থাকা জরুরী। পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। প্রবাসীদের যথাযথ মর্যাদাদানপূর্বক তাদের মধ্যে করোনা আক্রান্তদের পৃথক করে কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে কোয়ারেন্টইন বা সঙ্গরোধ নিশ্চিত করার কার্যক্রম বেগবান করা উচিত। সংক্রমণের চেইন ভাঙ্গতে আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও খুজে বের করে তাদের সঙ্গরোধ অনুশীলন আবশ্যক। সন্দেহভাজন হলেই পরীক্ষা নিশ্চিত করা এবং স্পর্শিতদেরও সঙ্গত্যাগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আমাদের বন্দর, এয়ারপোর্টে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। ফলশ্রæতিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে অত্যাধিক সচেতনতা বৃদ্ধিপূর্বক কমিউনিটিতে ভাইরাস ছড়ানোর পথ রুদ্ধ করতে হবে। করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি থেকে তরুণরাও মুক্ত নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তরুণদেরকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বয়স্ক ও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের সংস্পর্শ থেকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। করোনা ভাইরাস সম্পর্কযুক্ত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি অনভিপ্রেত। সম্পর্কিত উপকরণ ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি দুঃখজনক। বাজার মনিটরিং পূর্বক নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহের সক্ষমতা যে বিদ্যমান সেই বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে ভোক্তাদের নিকট। শ্রমজীবী, গার্মেন্টস কর্মী, দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্য ও সুলভ মূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও সেবা সরবরাহের উদ্যোগকে প্রাধান্য দিলে সামষ্টিক কল্যাণ বয়ে আনবে। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, কারাগারের জনাকীর্ণতা, ধর্মীয় স্থানসমূহে বিশেষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। ট্রেনস্টেশন, লঞ্চঘাট ও গণপরিবহন যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষার উদ্যোগ ও সকলের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত কার্যকর প্রয়াস নিতে হবে। আমরা নিজেরা সচেতন হলে হবে না বরং দেশের সকলকে সচেতন করে তোলার পদক্ষেপ প্রসারিত করা প্রয়োজন।
আমরা জানি, সরকার ইতোমধ্যে করোনা প্রতিরোধে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোসণা করে এ ভাইরাস প্রতিরোধে তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের স্ববিস্তার উল্লেখ করেন এবং সমাজিক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশনা যথাযথ পালনের জন্য দেশের সর্বস্তরের জনগণকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এরপরও আমরা মনে করি, করোনা ভাইরাস’র মতো অদৃশ্য শক্তিশালী বিপদ থেকে উত্তরণকল্পে বাংলাদেশকে সকল শ্রেণি-পেশার নীতি নির্ধারকদের সমন্বয়ে জাতীয় কৌশলপত্র নির্ধারণ করে তা সর্বত্র পৌঁছাতে হবে। সরকারের কর্মকৌশলগুলোর সাথে ব্যাপক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। জাতীয় কৌশলপত্র বিশেষত ন্যাশনাল গাইডলাইন তৈরী করে দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে করোনা জয়ের লক্ষ্যে সমৃক্ত করতে হবে। জীবাণুুমুক্ত একটি কমপ্লেক্স হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়। এছাড়াও স্ক্রিনিং, সঙ্গত্যাগ, পরীক্ষা প্রভৃতি বিষয়াদির কৌশলাদি সুনিপুনভাবে সম্পন্ন করতে হবে। চলমান এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর পাশাপাশি বেসকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলোর সাথে সংযুক্ত নীতির ভিত্তিতে সক্ষমতা বৃদ্ধিপূর্বক অগ্রসরতা কাম্য। করোনা রোগীদের জন্য আলাদা অ্যাম্বুলেন্সসহ উপকরণাদিও আলাদা করা বাঞ্চনীয়। মৃত্যুর পথযাত্রা থামাতে জানতে হবে কারা আক্রান্ত। প্রযুক্তির ব্যবহার ও সেবা বাড়াতে হবে সকল পর্যায়ে। প্রবাসীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানসহ আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, স্বাস্থ্য খাত, পর্যটন, প্রবাসী আয়, খাদ্য নিরাপত্তা, রাজস্ব প্রভৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শ্রমনির্ভর লোকজন অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও শ্রমজীবিদের নীতি সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা দেয়া দরকার। দেশপ্রমিক তরুণ প্রজন্ম স্বেচ্ছায় ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ ও মাস্ক প্রভৃতী তৈরী করছে, যা মানবিকতায় অনন্য দৃষ্টান্ত।
বেসরকারী ও ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতাধর্মী উদ্যোগ প্রশংনীয়। এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ সচেতনতার যে আবহ তৈরী করতে সমর্থ হয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট চিত্তে অবগাহন করা সমীচিন হবে না, সকল ক্ষেত্রেই সচেতনতার বার্তা পৌঁছাতে হবে। সত্যিকারের পরিচ্ছন্নতা আন্দোলন প্রসারিত হোক। ধনী-দরিদ্র, রাজনৈতিক ভেদাভেদ, ভৌগোলিক সীমানা ও সকল ধরনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ভুলে আসুন আমরা পৃথিবীকে করোনামুক্ত করতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হই। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষত টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট এসডিজি (৩) সকলের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত হোক। দুর্যোগ থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে গড়ে তুলি বৈষম্যহীন ও মানবিক পৃথিবী। সম্প্রতি চীন মেডিকেল মাক্স পাঠিয়েছে অত্যাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ইতালিতে, আর সেখানে বাক্সের উপর লিখা আছে চীনা ভাষার একটি কবিতার লাইন। ‘নদী আর সাগরের দিক থেকে আমরা হয়তো আলাদা, কিন্তু একই আকাশ, সূর্য আর চাঁদের আলোর নীচে আমাদের বসবাস’।
লেখক: সভাপতি, এসডিজি ইয়ুথ ফোরাম