করোনা ভাইরাস চার কারণে চট্টগ্রামে বাড়ছে সংক্রমণ

132

আসহাব আরমান
চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমার প্রবণতা থাকলেও মার্চ থেকে করোনা আবার চোখ রাঙানি শুরু হয়েছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকে অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে। পুরো দেশের চিত্রও একই। শীত মৌসুমে সংক্রমণ বাড়ার কথা থাকলেও খুব একটা বাড়েনি। তবে তাপমাত্রা বাড়তেই সংক্রমণও বাড়ছে।
মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা, বিয়ে-শাদী, মেজবান ও নানা রকম সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতা, টিকাকেন্দ্র ঘিরে হুড়োহুড়ি ও প্রশাসনের উদাসীনতায় সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিন নগরীর বিভিন্ন স্থানে ২০০ জন মানুষকে নজরদারি করে দেখা যায়, প্রতি ১০ জনে ৬ জনের মুখেই মাস্ক নেই। অর্থাৎ ২০০ জনের মধ্যে ১২০ জনই মাস্কহীন চলাফেরা করছেন। আগে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হতো। মাঝপথে অভিযান কেন্দ্রিক প্রশাসনের তৎপরতাও থেমে যায়। যদিও গতকাল থেকে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে জেলা প্রশাসনের অভিযান পুনরায় চালু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে ১৭০টি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। এগুলোতে নিয়ম করে প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে বিয়ে-মেজবানসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান। ফলে প্রতিনিয়ত শত মানুষের জনসমাগম হচ্ছে এসব কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে। স্বাস্থ্যবিধি মানার নিয়ম থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করছেন না কেউ।
এদিকে করোনার টিকা নিতে গিয়েও প্রতিদিন শত শত মানুষের সমাগম ঘটছে। করোনা থেকে বাঁচতে নিজের অজান্তেই করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। নগরীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন লোক সমাগম হলেও তদারকি নেই কোথাও।
কমিউনিটি সেন্টারে সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সাথে থাকা লোকমান হোসেন বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর কমিউনিটি সেন্টারগুলো চালু হয়। তবে প্রথমদিকে ক্লাবে বিয়ে চলাকালীন ম্যাজিস্ট্রেট এসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না তদারকি করতেন। বিয়ের আয়োজনের পরিধি কত তাও তদারকি করা হতো। তবে কয়েকমাস ধরে প্রশাসনের কেউ এসব তদারকিতে আসছেন না বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া পূর্বদেশকে বলেন, রেস্টুরেন্ট, বিয়ে, মেজবান, পিঠা উৎসব, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশসহ সব জায়গায় বেড়েছে জনসমাগম। শত শত মানুষ দেদারসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কারো মুখে মাস্ক নেই। এছাড়া ভ্যাকসিন চলে আসায় মানুষ মোটেও স্বাস্থ্যবিধির তোয়ক্কা করছেন না। গত কয়েকমাসে চট্টগ্রামে জনসমাগম বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুন। ফলে প্রতিদিন সংক্রমণ বেড়েছে। সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও জনগন সচেতন না হওয়ায় এমনটি ঘটছে।
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন আসার পর থেকে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা গড়ে উঠেছে যে, ভ্যাকসিন নিলে আর মাস্ক পরতে হবে না। এটা ভুল ধারনা। তবে ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ ডোজ নেওয়ার শরীরের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি হতে এক মাস সময় লাগে। সুতরাং ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
চট্টগ্রাম সিভিল কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে এক হাজার ৭১১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৫৩ জনের শরীরো করোনা শনাক্ত হয়েছে। নমুনা অনুপাতে শনাক্তের হার ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এনিয়ে চলতি বছরে দ্বিতীয় দিনের মতো চট্টগ্রামে শনাক্তের সংখ্যা দেড়শ ছাড়ালো। গত ১২ দিনে চট্টগ্রামে করোনা শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৩৬০ জন। এর আগে চট্টগ্রামে ১৪ মার্চ ৯৪ জন, ১৩ মার্চ ১৩১ জন, ১২ মার্চ ১৩১ জন, ১১ মার্চ ১৩২ জন, ৯ মার্চ ১২২ জন, ৮ মার্চ ১১৪ জন, ৭ মার্চ ৬৩ জন, ৬ মার্চ ৯২ জন, ৫ মার্চ ১০৭ জন এবং ৪ মার্চ ৯৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি পূর্বদেশকে বলেন, শুধু চট্টগ্রাম নয় সারাদেশেই সংক্রমণ বাড়ছে। জনসাধরণের স্বাস্থ্যবিধি না মানাই এর অন্যতম কারণ। ভ্যাকসিন আসার পর থেকেই মানুষের মধ্যে একটা গাছাড়া ভাব চলে আসছে। মাস্ক না পরেই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে, প্রতিনিয়ত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে জনসমাগম কমাতে প্রবাসীদের নমুনা নেওয়ার জন্য দুটি বুথ স্থাপন করেছি।
তিনি আরো বলেন, জেলা প্রশাসনের অভিযান একেবারে বন্ধ হয়নি। হয়তো দুয়েকমাস আগের মতো ব্যাপক হারে চালু ছিল না। তবে গতকাল থেকে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনের অভিযান পুনরায় আবার চালু হয়েছে। প্রশাসন যতই কঠোর হোক না মানুষকে আগে সচেতন হতে হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের অভিযান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হয়নি। হয়তো সংক্রমণ কমে আসায় আগের মতো ব্যাপক হারে হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সংক্রমণ আবার বৃদ্ধি পাওয়ায় গতকাল পুনরায় জেলা প্রশাসনের অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এ সময় নাগরিকদের মধ্যে দুই হাজার মাস্ক বিতরণ করা হয়।
এক লাফে দৈনিক আক্রন্তের হার ৯ শতাংশে : চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৭১১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। নমুনা অনুপাতে শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অথচ একদিন আগে শনাক্তের হার ছিল ৬ শতাংশ। একদিনের ব্যবধানে শনাক্তের হার বাড়লো ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ফলে ৬৯ দিন পর শনাক্ত রোগী চট্টগ্রামে একদিনে দেড়শ ছাড়িয়ে গেলো।
সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামে দেড়শ’র বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আক্রান্তদের মধ্যে মহানগরের বাসিন্দা ১৪০ জন ও সাত উপজেলার ১৩ জন। এ নিয়ে চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৫৫৬ জন।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে করোনায় কারো মৃত্যু হয়নি। এই পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনায় মারা গেছে ৩৮১ জন। গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, চট্টগ্রামের ৬টি ল্যাব ও কক্সবাজার মেডিকেলে এক হাজার ৭১১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫৩ জনের শরীরে কোভিট পজিটিভ হয়েছে। তবে এ সময় চট্টগ্রামে করোনায় কারো মৃত্যু হয়নি।
ল্যাবভিত্তিক তথ্যমতে, ফৌজদারহাটস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস ল্যাবে ৭৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৯ জন করোনা রোগী পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ল্যাবে ৪৫২ জনের নমুনার মধ্যে গ্রামের ৭ জনসহ ৫৬ জনের করোনা শনাক্ত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে ১২৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হলে ২২ জন জীবাণুবাহক বলে চিহ্নিত হন। নগরীর একমাত্র বিশেষায়িত কোভিড চিকিৎসা কেন্দ্র আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আরটিআরএল ল্যাবে ৭টি নমুনায় ৪টিতে করোনা মিলেছে।
বেসরকারি তিন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরির মধ্যে শেভরনে ২৭৭টি নমুনা পরীক্ষা করে গ্রামের ২টিসহ ২৯টি এবং মা ও শিশু হাসপাতাল ল্যাবে ৩৩টি নমুনার মধ্যে ১৩টিতে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মা ও শিশু হাসপাতালের ১৩ জনই শহরের বাসিন্দা। চট্টগ্রামের ৬৮ জনের নমুনা কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। এতে সবগুলোর ফল নেগেটিভ আসে।