‘করোনা ভাইরাস’ এখন টক অব দি গ্লোব, টাউন বা কান্ট্রি নয়

100

কাজি রশিদ উদ্দিন

‘করোনা ভইরাস’ শব্দ এখন আর টক অব দি টাউন নয় বরং এটা এখন টক অব দি গ্লোব (বিশ্বের আলোচিত বিষয়)। এ পর্যন্ত ১২৩টার দেশে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই রোগের মূল বৈশিষ্ট হলো এটা ছোঁয়াছে, সাথে মানুষের পরস্পরের ছোঁয়াছুয়িতেই (যেমন কোলাকুলি বা হ্যান্ডশ্যাক) এটা অন্য মানুষের শরীরে ছড়াতে বা প্রবেশ করতে পারে। তবে কারোনা ভাইরাস নিয়ে সাড়া বিশ্বজুড়ে চলছে এক মহা আতংক। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে এ পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার মানুষের সংখ্যা সাড়ে তের লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে মারা গেছে প্রায় লাখের কাছাকাছি। তবে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে যতই বিলাসী জীবন যাপন করি না কেন, জীবনের মূল্য খুবই সামান্য। আজ বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস আমাদের সেই শিক্ষা দিচ্ছে। আমরা বিশ্বের দন্ডমুন্ডের কর্তা বলে যাকে মনে করি সেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত নিজের হাত মুখে লাগাতে ভয় পচ্ছেন। অতি খুর্দাদিক্ষুর্দ একটি জীবানু গোটা মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এতে বুঝা আসরে মানুষ কত অসহায়। এক অজানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব। এর থেকে মুক্তির উপায় এখন পর্যন্ত কারো জানা নেই। ২০২০ থেকে ২০২২ হওয়ার কথা জীনের ইতিহাসের স্বর্ণালি বছর। তবে সব ওলটপালট করে দিয়েছে করোনা। চীন বিশ্বে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছে।
চীনের প্রধান শক্তি ব্যবসা-বাণিজ্য যে স্থানে করোনা আঘাত হেনেছে। চীনের ব্যবসা বাণিজ্য এখন দমবন্ধ অবস্থা। অনেক শহরের অবস্থা মৃত্যুপুরীতুল্য। চাইনিজরা দিনদিনই হয়ে উঠেছে অসুস্থ। বিশ্বে সবচেয়ে নোংরা খাবার খায় চীনারা। এর মাধ্যমেই কি করোনা ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে। আমরা জানিনা অনেকেই বলেছেন, করোনা ভাইরাসটি মূলত ‘আল্লাহর গজব’ বা অভিশাপ। কিন্তু অহেতুক বা অতিরিক্ত আতংকিত হওয়ার কোনো যক্তি নেই। কারণ মহান আল্লাহ মানবজাতিকে বিপদ বিপর্যয় যেমন দিয়েছেন তেমনি তা থেকে উত্তরণের উপায়ও দিয়েছেন। বিপদ আপদ পার্থিব জীবনে অপরিহার্য এবং এ কারণে তা স্বাভাবিক। তবে এটা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধান হওয়াই বড় কথা। ইসলাম দোয়া ও দাওয়া দুটোকেই গুরুত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর রহমত এবং মানুষকে তার প্রদত্ত উদ্ভাবনী প্রতিভাজাত ওষধপত্র উভয়ই মানুষের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। একইভাবে বলতে হয় বিশ্বেজুড়ে যে কারোনা আতংক বিরাজ করছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে এর থেকে কী শিক্ষণীয় রয়েছে। সেটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ বিপদ আমাদের ওপর আপতিত হওয়া অসম্ভব নয়।
এ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকা বা মিডিয়ায় যে সব আলোচনা পরামর্শ অভিমত প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছে। তার আলোকে বলা যায়। বিদ্যমান করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মহা ঘটনা মানবজাতিকে কয়েকটি ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদ দিচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো করোনার উৎপত্তিস্থলের কিছু বিষয়। যেমন খাদ্যাভ্যাস, পরিচ্ছন্নতা সীমালংঘন, আল্লাহর অনুগত্য থেকে বিচ্যুতি প্রভৃতি। সেই চীন থেকে করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে এশিয়ার ইরান থেকে ইউরোপের ইতালি হয়ে আটলান্টিক সংলগ্ন স্পেনে। শুধু চীন নয়। মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সব দেশ ও জাতি নিজেদের কর্মকান্ড পর্যালোচনা করে দেখা উচিত গভীরভাবে।
পরিবেশবিজ্ঞানের ভাষায় করোনাভইরাস প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতিকে নিজ্জীব। চলৎশক্তিহীন ও সর্বংসহা মনে হলেও আসলে তা নয়। এবং তা নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণকারী। প্রকৃতি কারো অনুপরিমাণ অপরাধও সহ্য করেনা। প্রতিশোধ হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সুনামি, মহামারী ইত্যাদি প্রকৃতিরই প্রতিশোধের হাতিয়ার। ১০ অক্টোবর ২০১৮ সালে মাইকেল সংবাদটি আগেই জানতে পেরেছিল বিশ্বের পরাশক্তি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিশ্বের শীর্ষে স্মাটআপ ও গুগলের তীর্থস্থান আমেরিকার মত দেশে, তবুও চেয়ে চেয়ে দেখা সহ কয়েক লাখ লোককে বিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া ছাড়া কিছুই করার ছিলনা। একইভাবে সুনামি, ভূমিকম্পের কথাও বলে আগুন ইত্যাদির কথা আমরা সবাই জানি। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার উত্তর দ্বীপে আঘাত হানে ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে। এর পরপরই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ সুনামি যা সোমালিয়ার উপকুল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সুনামিটি ভারত মহাসাগরের অনেক দেশই আঘাত হানে। কেবল ইন্দোনেশিয়াতেই এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। এটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগগুলোর একটি হিসাবে ধরা হয়।
অনেক যুগ থেকে মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়েছে বলা যায় না। প্রকৃতি প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু। এ মোকাবেলায় মানুষ বড়ই অসহায়। সাত দশক আগে ১৯৪৯ সালে চীনের ঘটনা চড়–ইপাখি কৃষকের ধান খেয়ে দেশের ক্ষতিকরে নতুন চীনের জনক মাশু সে তুং একদিন সিদ্ধান্ত নিলে, সময় হয়েছে চড়ই পাখি বিলুপ্ত করার। সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করা হয়েছিল। এমন নির্বোধ কর্মকান্ডের খেসারত দিতেও বেশি সময় লাগেনি। পরের বছরই ধেয়ে এসেছে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ । কারণ শস্যদানার পাশাপাশি চড়ই পাখি নানা ধরনের পোকামাকড়ও খায়। এ পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেলো পোকা মাকড়ের সংখ্যা। এতে করে ফসলের ক্ষেত ছেয়ে যেতে থাকে ক্ষতিকর পোকামাকড়ে। ফলে, যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হলো তা গেল পোকামাকড়ের পেটে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শষ্যভান্ডার খালি হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের মজুদ করা খাদ্যেও ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্য সংকটের মুখে পড়ে যায় কোটি কোটি মানুষ। দেখা দিলো দুর্ভিক্ষ, ফলে পরবর্তী তিন বছরেই প্রাণহানির সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় ৪৫ মিলিয়নে। এ দুর্ভিক্ষ ‘দ্যা গ্রেট ফেমিন’ নামে পরিচিত।
প্রকৃতির নিয়ম খুবই সুশৃংখল এর চিরন্তন নিয়মের কখনো ব্যতায় ঘটেনা। সূর্য পূর্ব দিকে উঠে আর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়- এই নিয়মে কোনো হেরফের নেই। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই কোনো না কোনো শৃংখলের অন্তর্ভুক্ত। এরা একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই উপাদানগুলোর কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, নষ্ট হয় পরিবেশগত ভারসাম্য। এই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব প্রকৃতির নিজ কাঁধে তুলে নেয়া। করোনাভাইরাস যদি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য হয়ে থাকে তবে ভারসাম্য ফিরে না আসা পর্যন্ত ২০১৮ সালে সাইক্লোনের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কোন বিজ্ঞান-প্রযুক্তিই হয়তো কাজে আসবেনা। তা হলে উপায় কী ?
বাংলাদেশ আজ করোনাভাইরাস ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছে। আমরা কি এই বিপর্যয় মোকাবেলা করতে পারব? বাংলাদেশের জনগণ এর উপর আমাদের আস্থা থাকা উচিত। মোকাবেলা দুঃসাধ্য বটে, কিন্তু মোটেও অসম্ভব নয়। সেটা সম্ভব যদি আমরা আতংকিত না হই। জনগণকেই এ ব্যাপারে সম্পৃক্ত করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট