করোনা প্রলয় ও সচেতন নাগরিক আচরণ

17

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

করোনা অতিমারির দুঃসহ প্রাদুর্ভাবের সূচনাকাল থেকে অদ্যাবধি সংক্রমণ বিস্তার ও প্রাণ সংহারের দৃশ্যপটে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব প্রচন্ড ক্ষত-বিক্ষত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনার প্রথম তরঙ্গের আঘাত সুচারু পরিকল্পনায় দেশের প্রতিরোধ-সাফল্য বিশ্বনন্দিত। করোনা যুদ্ধজয়ের গৌরবগাঁথা দেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ অবস্থানে উন্নীত করেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা-গৃহীত পদক্ষেপের যথার্থ প্রতিপালনে সামষ্টিক অর্থনীতিকে সচল রেখে দেশবাসীর জীবনপ্রবাহে গতিসঞ্চারের মহিমায় সরকারের ভূমিকা সর্বত্রই সমাদৃত হয়েছে। ভ্যাকসিন সংগ্রহ-বিতরণ ও প্রয়োগে যথাযথ ব্যবস্থাপনাও সমধিক প্রশংসিত। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস ও সমৃদ্ধ কর্মকৌশল জনগণের মধ্যে আস্থা এবং ভয়কে জয় করার প্রোৎসাহিত সন্তুষ্টি প্রশমন পরিক্রমায় ইতি-নেতিবাচক প্রভাবও দৃশ্যমান। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহতা দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভয়ঙ্কর প্রলয়ে রূপান্তরিত।
প্রাসঙ্গিকতায় ১৯০৭ সালে বিশ্বকবি রবীঠাকুর রচিত কবিতার কয়েকটি পংক্তির বন্দনা করতে চাই। ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা,/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।/দুঃখ তাপে ব্যথিত চিত্তে নাই-বা দিলে সান্ত¦না,/দুঃখে যেন করিতে পারি জয় \/সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে,/সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা/নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।’ সম্ভবত রবীঠাকুর বিশ্বখ্যাত মানব বিধ্বংসী দেশ-মহাদেশ ব্যাপ্ত ব্যাধি বা মহামারি সম্পর্কে সম্যক ধারণাঋদ্ধ ছিলেন বলেই এই অসাধারণ মনন-সৃজিত কবিতায় ধারয়িষ্ণু শক্তিমানতার প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় প্রায় বার হাজার বৎসরের অস্তিত্ব-অভিজ্ঞতায় কেবল জলবসন্ত রোগে তিন থেকে পাঁচ কোটি প্রাণ বিনাশের বিষয়টি অনেকেরই অজানা নয়। ১৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন মিসর, গ্রীস ও ইতালিসহ অন্যান্য অঞ্চলে ‘এন্টোনাইন প্লেগে’ মৃতের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ লক্ষ।
৫৪১-৫৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগে’ আক্রান্ত প্রায় আড়াই কোটি ইউরোপবাসী, ১৩৪৬-১৩৫৩ সালে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় প্লেগ রোগের কারণে ‘কালো মৃত্যু’র শিকারে প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে বিশ কোটি, ১৮৫২-১৮৬০ সালে তৃতীয় কলেরা মহামারির ফলে ভারতবর্ষ, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং আফ্রিকার প্রায় দশ লক্ষ (ইংল্যান্ডে ছিল তেইশ হাজার), ষষ্ঠ কলেরা মহামারিতে (১৯১০-১৯১১) মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়ায় আট লক্ষ, ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লুতে প্রায় পুরো বিশ্বব্যাপী দুই থেকে পাঁচ কোটি, ১৯৫৬ -১৯৫৮ সালে চীনে উদ্ভূত এশিয়ান ফ্লুতে সিঙ্গাপুর, হংকং ও আমেরিকাতে বিশলক্ষ (শুধু আমেরিকাতে উনসত্তর হাজার আট শত), ১৯৬৮ সালে হংকং ফ্লুতে দশ লক্ষ, ২০০৫-২০১২ সালে এইচআইভি/এইডস এর কারণে বিশেষ করে সাব-সাহারা আফ্রিকায় প্রায় তিন কোটি ষাট লক্ষ মানব সন্তানের প্রাণ নিধনের ঘটনা পুরোবিশ্বকে করেছিল সংহিত আতঙ্কিত ও শঙ্কিত।
পৃথিবী নামক এই গ্রহে প্রাচীনকাল থেকেই প্রাণঘাতি ব্যাধি যেমন জলবসন্ত, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, য²া, টায়ফুজ, হাম, কুষ্ঠরোগ, হলুদজ্বর, ইবোলা ও জিকা ভাইরাস ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ে মানব সমাজকে করেছে অতিশয় বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। কালক্রমে এর পরিত্রাণ ও উপশমে নানা চিকিৎসা উদ্যোগ সফলতার স্বাক্ষরও রেখেছে। সকাতরে মানব সমাজ বিভিন্ন অভিচারক্রিয়ায় এসব মহামারিকে বশীকরণ করার পন্থাও উদ্ভাবন করেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ পর্যায়ে চীনের উহান থেকে উত্থিত ‘করোনাভাইরাস- কোভিড ১৯’ নতুন করে বিশ্বকে অনাকাক্সিক্ষত আকস্মিক সংকটে প্রকম্পিত করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ কোভিড-১৯ কে বিশ্ব মহামারি ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ইউরোপের দেশসমূহে করোনাভাইরাসের দ্রæত প্রসার ও মৃত্যুহার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান জনাব টেড্রস অ্যাডানম গেব্রিয়াসিস এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ইউরোপকে এই মহামারির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে যাচিত করেছেন। ইতালি ও স্পেনে এর বিস্তার পুরো ইউরোপকে পরিণত করেছিল বিশ্বের সবচেয়ে আক্রম্য অঞ্চলে।
দুঃখজনক হলেও সত্য বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪.৮৯% জনগণের বসবাস দক্ষিণ এশিয়া এবং প্রতি কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩০৩ জন। জনবহুল ঘন বসতিপূর্ণ আবাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ এশিয়ায় করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি এবং ফলস্বরূপ নানাবিধ সংকটের মর্মভেদী সংকেত আরোপ করেছে। শ্বাসযন্ত্রকে আক্রান্ত করে তীব্র আঘাতে মানুষের ফুসফুসে এই রোগের সংক্রমণ এবং জীবন ঝুঁকির মুখোমুখি অসহায় জনগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত জানপদ সচেতনতা অনেকটা আতঙ্কিত করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরোল্লেখিত পরিসংখ্যানে নব্বই শতাংশ আক্রান্ত রোগী সুস্থ জীবন-যাপনে তদবস্থ হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্র-সরকার-সমাজের নারী-পুরুষ-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধ ও একমুখী আরোগ্য অনুসন্ধান সম্পর্কে সতর্কতাই নিরন্তর প্রতিপোষিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই ভাইরাসের বিস্তার মূলতঃ প্রবাসীদের দেশে ফেরা এবং পরিবার-প্রতিবেশির সংস্পর্শে দিনযাপনের শিকড়ে অনড়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সঙ্গত কারণেই কোয়ারেন্টাইনে থাকা একান্তই অপরিহার্য। তবে এই সংক্রান্ত গুজব, অতিমাত্রায় সামাজিক যোগাযোগ ও জনাগ্রহে নিরীহ জনগণকে শঙ্কিত করার সকল অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ করোনা প্রতিরোধে যথার্থ অনুষঙ্গ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত বছরের ১৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় প্রত্যুপক্রম উচ্চারণে বলেছিলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করবেন না, শক্ত থাকুন। সচেতন হোন। রেডিও টেলিভিশনসহ অন্য মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ান। মানুষকে বুঝিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’ বিজ্ঞজন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এই ধরনের পরিচিন্তন নির্দেশনা নি:সন্দেহে প্রয়োগিক সচেতন-প্রবলতা বার্ণিক উপাদানে পরিশুদ্ধ ও সতর্কতা অবলম্বনে উক্ত বাচনিক ভৈষজ্য জোরালো অবদান হিসেবে প্রণিধানযোগ্য। ইতিমধ্যে জনগণের সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় সরকার কর্তৃক গৃহীত কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, পর্যাপ্ত পরীক্ষণ কিট সংগ্রহ, গণস্বাস্থ্য সংস্থাকে কিট তৈরির অনুমোদন, প্রবাসীদের প্রতি প্রশাসনের বিশেষ নজরদারী, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ, সেনা বাহিনীর সহায়তায় সংশ্লিষ্ট সুবিধার সম্প্রসারণ অবিমিশ্র সুদূরপ্রসারি বিচক্ষণতা স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
দেশের আপামর জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে এই প্রাণঘাতি রোগ উপশমে বিমৎসর পন্থা নির্ধারণে অধিকতর প্রচার, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যথাযথ ব্যবহারের গুরুত্ব বিবেচনায় দেশবাসী অত্যধিক উপকৃত। ঝুঁকি এড়াতে উল্লেখিত করণীয় সম্পর্কে জনগণকে নব উদ্যমে সচেতন করা এবং সতর্ক থাকার মধ্যেই করোনা প্রলয় প্রতিরোধে উৎকৃষ্ট অনুসর্গ হিসেবে বিবেচ্য হবে। আমারাজানি যে, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ বা প্রাণীর পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রকাশ্য অভিব্যক্তি বা পঠন-পাঠন-গ্রহণ-বর্জন-কাঠামো পরিবর্তন ইত্যাদি আচরণগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে ব্যক্তির চিন্তা-উপলব্ধি-অনুভূতি-মূল্যবোধ-নীতি নৈতিকতা-সততা ও সত্যবাদীতা ইত্যাদি অপ্রকাশ্য কর্মযজ্ঞের সমাহারকে আচরণ বলয়ে পর্যবসিত করা হয়। বিশ্বের আচরণবাদের উৎপত্তি ও বিকাশে যাকে অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয় তিনি হচ্ছেন জন বি. ওয়াটসন। ওয়াটসনের মতানুসারে, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ কালোত্তরণে উদ্ভূত চেতনা থেকে সহজাত প্রবৃত্তি কেন্দ্রিক অর্জিত আচরণের ফলশ্রæতিতেই সমাজ জীবন সর্বাধিক প্রভাবিত। চলমান সমস্যার অনুধ্যান এবং এর থেকে পরিত্রাণে সম্ভাব্য স্বরূপ উদঘাটন ও সমাধানকল্পে আচরণগত পরিবর্তনই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
সময়ের আবর্তনে ধারাবাহিকতায় সভ্যতার ইতিহাসে কৃতাভিষেক প্রকীর্তি মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মানবকল্যাণে আত্মত্যাগের প্রগত অনুক্রম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। এই মহাননেতার ‘স্বাস্থ্যসেবা দর্শন’ সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবী নামক এই গ্রহে ভয়াবহ করোনা আক্রান্তের কঠিন ক্রান্তিলগ্নে দিগ্ভ্রান্ত পরিক্রমায় মহামারি প্রতিরোধে এক অবর্ণনীয় শিক্ষণ, প্রশিক্ষণের ‘ইতিহাস দর্শনের’ মৌলিকত্তে¡ বৈজয়িক। ১৯৭২ সাল, ৮ অক্টোবর পি. জি. হাসপাতালের রক্ত সংরক্ষণাগার এবং নতুন মহিলা ওয়ার্ডের উদ্বোধন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণের প্রায়োগিক পরামর্শ ছিল, ‘সেবার মনোভাব নিয়ে মানুষকে সেবা করুন’। ভাষণের শুরুতে পোষ্ট-গ্রাজুয়েট মহাবিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ নুরুল ইসলামের বারণ সত্তে¡ও অনুষ্ঠানের যোগদানের পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। অত্যন্ত আনন্দচিত্তে এই ধরণের সেবার প্রয়োজন, আয়োজন এবং গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু হৃদয় নিঙড়ানো শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সমৃদ্ধ অপরিমেয় অনুপ্রেরণায় উপস্থিত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে সম্ভুদ্ধ মানবিকতার আদর্শ উচ্চকিত করেন। মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাসের স্বাধ্যায় উচ্চারণ ছিল, ‘শোন হে মানুষ ভাই, সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।’ বিশ্বকবি রবীঠাকুর তাঁর জীবন সায়াহ্নে লেখা ‘সভ্যতার সংকটে’ বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ প্রয়াণের সাত দিন আগে মুখে মুখে বর্ণিত কবিগুরুর জীবনের শেষ কবিতার কয়েকটি পংক্তি ছিল, – ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে!/এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;/… সত্যেরে সে পায় আপন আলোকে-ধৌত অন্তরে অন্তর।’ রবীঠাকুর বিশ্বাস করতেন ধর্মের প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্তে¡র অনুভূতি ইন্দ্রিয়বৃত্তির চর্চা হতে পারে, জীবনের আদর্শিক গন্তব্য সন্ধান বা বিবেকের জয় নিশ্চিত করা দুরূহ বিষয়। সততা ও আচরণের আন্তরিকতাই মরণোত্তর সঞ্চরণে সতীর্থ অনুষঙ্গ। বঙ্গবন্ধু রবীঠাকুরের বিশ্বমানবিকতার এই নিখাঁদ রাখিবন্ধনে নিরন্তর মন্ত্রিত ছিলেন বলেই কালোত্তীর্ণ মহামানব হতে পেরেছিলেন।
জাতীয় কবি নজরুলমানসেও প্রচীয়মান ছিল এই মানবিক দ্যোতনা। নির্বাধ পাঠান্তরে গ্রন্থিত ছিল, ‘শাস্ত্র না ঘেটে ডুব দাও সখা, সত্যসিন্ধু জলে।’ সত্যের অনুসন্ধানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ছুটাছুটি না করে মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করাই ছিল তাঁর কাছে মনুষ্যত্বের পূর্ণানন্দ স্বর্বৈদ্য। সাম্যের কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।/গাহি সাম্যের গান।/কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?/কনফুসিয়াস? চার্বক্ -চেলা? …কিন্তু কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?/দোকানে কেন এ দর কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!/তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,/সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ!’ এভাবেই মহামানবগণ বিশ্ব-মানবিকতার মনন-সৃজনে সকল প্রতিকূলতাকে অবজ্ঞা করে জড়ত্ব, আড়ষ্টতা পরিহারে বিশ্বকে আলোর পথে এগোনোর শক্তি-সাহস যুগিয়েছেন। করোনাকাল বা তত্তাবৎ দুর্যোগ-তাÐবে বিশ্ব হাহাকারের নির্মমতা কবির মতো বঙ্গবন্ধুও দিগঙ্গনা করতে পেরেছিলেন বলেই বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দিদৃক্ষু ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ভাষণে অর্থ-বিত্তের প্রয়োজনীয়তার সাথে অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে ‘মানবতাবোধ’কেই প্রাগ্রসর জনশক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে অভিহিত করেছেন।
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে অন্যতম সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন , ‘যেখানেই যান দেখবেন সব কিছু বাংলাদেশের দুঃখি মানুষের পয়সায় গড়া। তাদের দিকে কেন নজর দিবেন না। সাদা কাপড়-চোপড় দেখলেই কেন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেন? আর দুঃখি মানুষ আসলেই কেন তাকে রাস্তার বাইর করে দেন, বয় বলে চিৎকার করেন? এই মনোভাবের পরিবর্তন কবে আপনাদের হবে! আমি শুধু আপনাদের ডাক্তার সাহেবদের বলছি না। এটা যেন আমাদের জাতীয় চরিত্রের মধ্যে এসে গেছে। এ জাতীয় চরিত্রের প্রতি চরম আঘাতের প্রয়োজন আছে। … আপনাদের কাছে আমি সেইজন্য আবেদন করবো যে, আপনাদের মানবতা বোধ দরকার, মনুষত্ব থাকা দরকার, সততা থাকা দরকার – না হলে কোন জাতি কোনোদিন বড় হতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধুর সেই অমিয় দর্শনকে ধারণ করে দৃঢ়ভাবে বলা যায়, দেশের সকল স্তরের স্বাস্থ্যসেবীরা মরণ ঝুঁকির বিনিময়ে করোনা প্রতিরোধে, আক্রান্তদের সেবা এবং সতর্কতা-সচেতনতা নির্মাণে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলছেন। দেশবাসীর উচিত; করোনা প্রলয় অতিক্রান্তে সার্বিক আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সতর্কতা ও সচেতনতাকে উজ্জীবিত করে প্রলয়ের উর্ধ্বমুখীতাকে রুখে দেওয়ার ব্রত গ্রহণ করা। স্বয়ম্ভু বৃত্তাভাস রচনা করে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে বাংলা নববর্ষের অবগাহনে দেশবাসী সতীর্থ মানবতার নকশীকাঁথায় পুরো জাতিকে ঢেকে দিয়ে প্রলয় বিজয়ের গান রচনা করবে- এই প্রত্যাশাটুকু ব্যক্ত করে নিবন্ধের ইতি টানছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী
সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়