করোনা: পাঠক অভিমত করোনা পরিস্থিতি বিশ্ব-ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন আনবে?

70

শরীফ মুস্তাজীব

এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় ১৭০ দেশে করোনা ভাইরাস এ আক্রান্ত। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি বিরাজমান সমগ্র বিশ্বে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো পর্যন্ত নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে করোনা মোকাবেলায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ সবকিছু স্থবির। এসবের মাঝে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে এই পরিস্থিতি পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। সার্বিক দিক বিবেচনায় দুটো দিক বলা উল্লেখ করা যায়ঃ ১. আগামী দিনগুলোতে নিরাপত্তার ধারণা পর্যালোচনা করতে হবে নতুন আঙ্গিকে। ২. বৈশ্বিক নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বিমেরু প্রবণতা।
প্রথম দিকটা খুবই স্পষ্ট। প্রথাগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা (traditional security policy) মানব জাতিকে নিরাপদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোন পারমাণবিক কিংবা সামরিক অস্ত্র নয়, একটি জীবাণু সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তাকে ভেঙে দিয়েছে। সামরিকখাতে রাষ্ট্রের ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক তা নিশ্চয়ই ভাববেন আগামী দিনে নীতি প্রণেতাগণ। বিশেষতঃ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ কিংবা শক্তিপ্রদর্শন (power politics) এর রাজনীতিতে যেসকল রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই তাদের নিরাপত্তানীতি পর্যালোচনার দাবি রাখে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সামরিক নিরাপত্তা ও এর বাণিজ্য প্রবণতার অকার্যকরিতা আবারো প্রতীয়মান হলো করোনা সংকটে। মানব নিরাপত্তা’র (human security) প্রাসঙ্গিকতা আবারো জোরালো হলো। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশগত নিরাপত্তা নিয়ে যুগপৎ ভাবতে হবে সামগ্রিকতা বিবেচনায়। নিরাপত্তা ধারনায় সামগ্রিকতার যুক্তিযুক্ততা আবারো আলোচিত হবে। করোনা সংকট যেভাবে বিশ্বব্যাপী দ্রুততার সাথে বিস্তার লাভ করেছে, তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না আমরা অনিরাপত্তার বিশ্বায়নে (globalization of insecurity) নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছি। এই ধরনের সর্ব ভবিতব্য (tragedy of commons) মোকাবেলায় বিশ্বকে একতাবদ্ধ হতে হবে নিরাপত্তার স্বার্থে। উল্লেখ্য, এতোদিন যে সকল নীতি প্রণেতাগণ পরিবেশগত সংকটের সার্বজনীনতা অস্বীকার করে আসছিলেন, ধারণা করে আসছিলেন যে এটি কোন কোন রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন সমস্যা; এই করোনা সংকট তাদের ধারণা পাল্টে দিবে।
এছাড়া আরেকটি বিষয়ও আলোচনায় এসেছে যে, করোনা ভাইরাস কোন জৈব অস্ত্র কি না। ইতোপূর্বে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বেশ ক’বার জৈব- রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হয়েছে। ইবোলা, এনথ্রাক্স এর মতো ঘটনাকেও জৈব অস্ত্র বলে দাবি করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতেও এই দাবি জোরালো হয়েছে। বলা হচ্ছে চীনের উহান প্রদেশের একটি গবেষণাগার থেকে এই ভাইরাস বিস্তার লাভ করে যেখানে চীন জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন করছিলো। আবার চীনও পাল্টা দাবি করেছে যে আমেরিকার একটি সেনাদল কিছুদিন পূর্বে উহান ভ্রমণ করেছে, তারাই এই জীবাণু ছড়িয়েছে। তবে উভয় দাবি এখনো প্রতিষ্ঠিত নয় কেননা চীন তার তথ্য প্রবাহকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যেকোন জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র মোকাবেলায় রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহ কতটা প্রস্তুত তা আলোচনার দাবি রাখে।
দ্বিতীয়ত, করোনা পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল সে তা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় একটি নেতৃত্বস্থানীয় দেশ হিসেবে তার ভূমিকা খুবই নগন্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে। তার সহযোগী রাষ্ট্রের অবস্থা মোকাবেলায় তো নয়ই, তার নিজের অবস্থা মোকাবেলায়ও সে ব্যর্থ- এটা দৃশ্যমান! এই সুযোগটি লুফে নিয়েছে চীন। করোনা ভাইরাস এর তথ্য গোপনের যে অভিযোগ ছিল চীনের বিরুদ্ধে তা অনেকটা প্রশমিত হয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতায়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ১৯১৮ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই ধরনের একটি মহামারীর আবির্ভাব হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে। ওই সময়ে তৎকালীন পরাশক্তি (যবমবসড়হ) যুক্তরাজ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়। এর ফলশ্রæতিতেই যুক্তরাজ্য বিশ্বব্যবস্থায় তার নেতৃত্ব হারায় বলে অনেকের মতামত। এই ধরনের দৃষ্টান্তের গ্রহণযোগ্যতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের ঔষধ আমদানির ৮০% আসে তার অন্যতম নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী চীনের কাছ থেকে। এবং সর্বশেষ দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই চীনের সাথে সমঝোতার সুরে কথা বলছে। চীন দাবি করেছে যে তারা যথাযথভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে এবং আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো চীনের উপর অনেকক্ষেত্রেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তা দৃশ্যমান। এই অবস্থায় প্রশ্ন তোলা যায় যে করোনা পরিস্থিতি চীনের অবস্থানকে আরো সুসংহত করেছে কি না। তবে এই ধারণায় উপসংহারে পৌঁছাতে আরো সময়ের প্রয়োজন!
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, এসডিজি ইয়ুথ ফোরাম।