করোনা পরবর্তী ইউক্রেন যুদ্ধকালীন বাজেট আরো বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাস্তবায়নে এগুতে হবে

14

 

বিগত দুটি বছর বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ঘোষণা করা হয়েছিল জাতীয় বাজেট। সেই সময় বাজেট যথাসময়ে পেশ করা যাবে কিনা সেই শঙ্কা যখন দেখা দিয়েছিল তখন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দক্ষতার সাথে বাজেট উপস্থাপন করে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। এবার আশা করা হয়েছিল একটি শান্তিপুর্ণ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করবে, কিন্তু সেটার উপায় কই? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির যে নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে তার ভার বইবার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। এখন বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। দেশে মূল্যস্ফীতির খবর মোটেই ভালো নয়। ডলারের দাম বেড়েই চলেছে। কারণ আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এতে কমছে রিজার্ভ। পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে সরকারকে কঠিন পরিস্থিতি, মোকাবিলা করতে হতে পারে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। আগামী অর্থবছরের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে যেসব বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান; বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন; অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তি আনার পাশাপাশি দেশের উন্নতি অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ে নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বৃদ্ধি করা। সে লক্ষ্যে আমদানিনির্ভরতা ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা হ্রাস করা হবে। নিম্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নের গতি হ্রাস করা হবে এবং একই সময়ে উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে। রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে কর সংগ্রহে অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে এবং মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের নেট বৃদ্ধি করা হবে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে এবং আন্ডার/ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে। মহামারীতে কাজের সুযোগ কমায় মানুষের আয়ে টান পড়েছে। তার ওপর জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ চায় স্বস্তি। তারা চায় কাজ। তেল-চাল কিনতে গিয়ে পকেট যেন গড়ের মাঠ হয়ে না পড়ে সেটিই সাধারণ মানুষের চাওয়া।
দেশের উন্নতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চাচ্ছে সরকার। উন্নতিকে হতে হবে টেকসই। আবার উন্নতির লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে নির্ধারিত সময়ে, ২০৪১ সালে। মহামারী উন্নতির গতি শ্লথ করেছে। এখন বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে হাজির হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তারপরও ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মানুষকে স্বস্তি দিতে হলে কর কমাতে হয়। আবার দেশকে এগিয়ে নিতে হলে রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতিশীলতা আনতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দেয়া আবার উন্নতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা বিদ্যমান বাস্তবতায় কতটা সম্ভব সেই প্রশ্ন রয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রী আশা ছাড়ছেন না। তিনি আশা করছেন, এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। নতুন অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। সামগ্রিক কর ব্যবস্থার সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানো না গেলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আয় বাড়াতে করদাতাদের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। মধ্যবিত্তদের অনেকেই করজালের মধ্যে আসবেন। কেবল করের টাকার ওপর নির্ভর করে বাজেট দেয়া হয় না। এর মধ্যে ধারদেনার হিসাবও থাকে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ করা না গেলে ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়ে। তাতে বাড়ে সুদ ব্যয়। দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা বাজেটে বৈধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কর দিয়ে এসব অর্থ বৈধ হয়ে গেলে তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। যদিও এই সুযোগ দেয়া কতটা নৈতিক সে প্রশ্ন উঠেছে। তবে অর্থমন্ত্রী বলছেন, এর ফলে অর্থনীতির মূল গ্রোতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে, আয়কর রাজস্ব আহরণ বাড়বে। করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বেশি কর্মসংস্থান হয় এসএমই খাতে কিন্তু সুবিধা বেশি পায় বড় শিল্পমালিকেরা। ব্যক্তির করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানো হয়নি। মূল্যস্ফিতীর চাপে পিষ্ট মানুষের জন্য করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানো জরুরি বলে অনেকে মত দিয়েছিলেন। ব্যক্তির করমুক্ত আয় সীমা না বাড়ায় মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্ত শ্রেণীর অনেক মানুষ বিপাকে পড়তে পারেন। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাল ও গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। সরকার আগামী অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিবন্ধী ভাতা বাড়ানো হয়েছে।
করোনা স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা-সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। তবে স্বাস্থ্য খাত বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ রাখা হয়ছে স্বাস্থ্যের জন্য। শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে মোট বরাদ্দ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আসন্ন অর্থবছরে মোট ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নে বরাবরই চ্যালেঞ্জ থাকে। মহামারী আর যুদ্ধ সেই চ্যালেঞ্জকে আরও বড় করে তুলেছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার যে লক্ষ্য অর্থমন্ত্রী নির্ধারণ করেছেন তা বছর শেষে কতটা অর্জিত হয় সেটাই দেখার বিষয়। আমরা আশা করি, বাজেট যাই হোক লক্ষ্য হবে জনগণের দুর্ভোগ কমানো আর উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখা।