করোনা ও সিটি নির্বাচননামা

220

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী

নির্বাচনে মাঠের চিত্র অত্যন্ত নাজুক। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের কথাই আগে বলি। সাংগঠনিক দুর্বলতা নাকি নৌকার দায়িত্বের বদলে প্রতিটি এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, ঠিক জানিনা, তবে একথা সত্য যে, মেয়রপ্রার্থীর নৌকার চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের অন্য প্রতীকের ঝনঝনানি বেশি। একটি ওয়ার্ডের সেন্টার কমিটির সম্পাদক জানালেন, পূর্ণ কমিটি এখনো না হওয়ায় গেল চারদিন ধরে সেন্টার কমিটির মিটিং হলেও চা খাওয়ানোর পয়সাটাও কেউ বের করে দেননি।…
পাহাড়তলীতে এক সময় বঙ্গবন্ধুর ছবি কুকুরের গলায় ঝুলিয়ে উপহাস করা নেতা যখন কাউন্সিলর মনোনয়ন পান তখন এ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু’র আদর্শের কর্মীদের মনে ঘৃণা না জাগার কোন কারণ নেই। এর পরেও নানামাত্রিক অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে রাজনীতি সচেতনদের মাঝে এ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। অবশ্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যারা এমন নির্বাচনের পরিকল্পনা করেন, তাদের কথা ভিন্ন।
এমন বিরূপ চিত্রের সাথে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ উদ্বেগ যুক্ত হওয়ার পরেও তাদের তো ঘুম ভাঙছে না !….
১.
এইতো কদিন আগে, উত্তর চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদ স্কুলের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুতেই জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। কিন্তু তার আগেই আত্মপক্ষ সমর্থন করে ব্যাখ্যা দিতে হলো। কারণ, মঞ্চে বসাদের মধ্যে দেখলাম অন্তত দু’জন অতিথি আছেন বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধ কাতারের, অর্থাৎ বিএনপি নেতা। দু’জনই উত্তর এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিএনপি নেতাদের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয়। অন্য অতিথিরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ অনুসারী। অনুষ্ঠানটিতে প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার রেজিস্ট্রেশনকৃত এবং বর্তমান প্রায় দেড় হাজার সহ অন্তত সাত হাজার মানুষের সমাগম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ সূচনার ঠিক কদিন আগেই এত বড় একটি বড় প্রীতি সম্মেলনে বক্তৃতার শুরুতে মাইক্রোফোনের কাছে যেতেই আমার মনে হল, দেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে শিক্ষা বিস্তারে, শিক্ষার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা উল্লেখ করতেই হয়। যদি আমরা দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে থাকি, বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্বীকার করা উচিত। এবং এরকম স্বীকারোক্তি কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা ঋণ স্বীকার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তবুও বক্তৃতার শুরুতেই কেন এই বিষয়টির অবতারণা করছি, তা নিয়ে ছোটখাটো একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেই হলো। কেননা, এদেশ এমনই একটি দেশ, যেখানে মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি, যোগ্যতার সম্মান জানাতে কার্পণ্যের রেওয়াজ রয়েছে। এদেশ এমনই একটি দেশ, কারো সফলতা দেখে অনেকের গাত্রদাহ হয় । কেউ সাফল্যের পাদপ্রদীপের আলোয় এগিয়ে যেতে চাইলেই তাকে পিছন টেনে ধরার মানসিকতা দিবালোকের মত সত্য। হয়তো এ কারণেই বাঙালির জাতীয় খেলা হাডুডু’- এমনটিই বলা হয়ে থাকে। আমাদের নেতিবাচকতা, বিকৃত মানসিকতা কিংবা অন্যের ভালো সহ্য করতে না পারা ক্রমে আমাদের মনস্তত্তে¡ ভীরুতার জন্ম দেয়। কিংবা অভিমান আসে। যে কারণে অনেক সত্য কথা আমরা বলতে পারি না কিংবা লিখতে পারিনা ।
সত্যটা লিখলেই কিংবা বললেই একটি পক্ষ মনে করে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন স্বার্থ জড়িত, কিংবা কারো লাভের বিষয় জড়িয়ে আছে। অনেকেই আবার সত্য প্রকাশকারীকে বিশেষ ঘরোনায় বন্দি করে রাখতে চান। সত্যের, সততার যে আলো, তাতে আলোকিত হতে চান না।
তাই ইদানিং অনেক সত্য প্রকাশ করি না। নীরব থাকি। থাকতে বাধ্য হই। এর মানে আবার ভীরুতা নয়, কিংবা নিজেকে বাঁচিয়ে চলাও নয়। ক্রমশ চাপা অভিমান থেকেই হয়তো এমনটি হয়। যার বা যাদের বা যে অঞ্চলের কিংবা দেশের, জনগোষ্ঠীর জন্য সত্য প্রকাশ করি, তারাই বা সেই জনগোষ্ঠী বা অঞ্চলের লোকজনেরা যখন সেটির কাসুন্দি ঘাঁটে, তখন ক্রমশ চাপা অভিমান বাড়ে। এমন অবস্থার বিপরীতে সত্যকে স্বাগত জানানোর পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের এক্ষেত্রে ভূমিকা যখন ইতিবাচক দেখি না, তখন ‘একলা চলো নীতিতে আর কতটুকু এগিয়ে যাওয়া যায়?! সাহস প্রত্যয় সদিচ্ছা তখন দুমড়ে মরে, গুমড়ে কাঁদে। আর তখনই পর্দা দুলে ওঠে অভিমানের ।
ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষটি টানা সংগ্রাম করে দফায় দফায় প্রায় ১৩ টি বছর জেল খেটে, সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়ে, নিজে কারাবন্দি থেকেও আপোস করেননি, আমাদের একটি রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন, সেই মানুষটিকে, সেই বাঙালি জাতির পিতাকে, সেই সাহসী বীর বঙ্গবন্ধুকে, সেই শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাতেও, কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ও আমাদের সার্বজনীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়, যাতে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া না দেখান !
২.
আগেই বলেছি, সব কথা লিখি না ইদানিং। বলিও না । তাই এতদিন ইচ্ছে করেই লিখি নি। কিন্তু এখন মনে হয়, কিছু লেখা দরকার। কিছু বলা দরকার। দেশজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ্বআগ্রাসনের। নবেল করোনা। আমাদের উদ্বেগের দুশ্চিন্তার পারদ বাড়ছে। আজকের দিনের সরকারি হিসেবে দেশে এই ভাইরাসে এই প্রথম একজন বৃদ্ধের মৃত্যু হল। বিলম্বে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দিতে বাধ্য হল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বলা হচ্ছে, জনসমাগম এড়িয়ে চলার। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে জনসমাগম রোধের প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মাহবুব রিপন ফেসবুক ওয়ালে সচিত্র মন্তব্য দিয়েছেন, যা অবশ্য আস্থা জাগানিয়া।
আরও হরেক রকম সচেতনতা প্রস্তুতির আওয়াজ আছে দেশে। বিশ্বজুড়ে। সর্বশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের বার্তা দিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য, কোথাও কমতি নেই যুগপৎ উদ্বেগ ও সচেতন পদক্ষেপের। মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডাসহ সব জায়গায় সতর্কতা। মক্কা-মদিনা ছাড়া সৌদিতেও সব মসজিদে নামাজ আদায় স্থগিত করা হয়েছে। এমন অবস্থায় দুর্যোগ ঝুঁকিতে আছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আর এই দেশে সরকার পরিচালনায় তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর দেশের সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে রাজনীতির জন্য উর্বরস্থান, দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের শহর ‘চট্টগ্রাম’।
এবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রাজনীতি সচেতনতা প্রসঙ্গে আসি
এত সতর্কতার মধ্যেও এই শহরের অর্থাৎ চট্টগ্রাম সিটির ভোট অত্যাসন্ন ২৯ মার্চ। ৬জন মেয়র প্রার্থীসহ নগরীর ৪১টি ওয়ার্ড ও ১৪ টি সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীরা রোজ ব্যাপক প্রচারণায় রয়েছেন। জন সমাগম হচ্ছে। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ফলে করোনার ঝূঁকি ক্রমশ বাড়ছে। একেতো বন্দর শহর হিসেবে, তার উপর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন(চসিক) নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে এই শহরটি মানুষেরা।
তৃণমূলের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নির্বাচন স্থগিতের দাবি তুলেছেন। কিন্তু দুই শীর্ষ দলের মেয়র প্রার্থী এ নিয়ে একবারও বলছেন না ‘নির্বাচন আপাতত স্থগিত করুন। জনস্বাস্থ্যের কিংবা জনস্বার্থের চেয়ে ভোট বড় কথা নয়।‘বিএনপি’র প্রার্থী ডা: শাহাদাত হোসেন তো বলেই বেড়াচ্ছেন, বাংলাদেশের যে আবহাওয়া তাতে করোনা ঝুঁকি নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন বলে জানালেও নিজে একটিবারও বলছেন না ‘এখন নির্বাচন চাইনা, জনস্বার্থই বড় ‘ ।
মাঠের রাজনীতিতে এই দুই মেয়র প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে কিছু বলার বা কোনো বিতর্কে যাওয়ার ইচ্ছাই আমার নেই। দু’জনেই দু’জনের দলের কাছে পরীক্ষিত এবং এ কারণেই তাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন।
আবার এটিও সত্য যে, এই দুই নেতা বা দুই মেয়র প্রার্থী চাইলেই যে দল কিংবা প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু হবে, তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। তাহলে একথা আমরা নিশ্চিত বলতেই পারে, এই দুই প্রার্থী চাইলেই চট্টগ্রামের সেবার পরিধি বাড়বে তারও গ্যারান্টি নেই। কাজেই এই নির্বাচন কার জন্য? প্রশ্ন উঠতেই পারে।
তাছাডা নির্বাচনে মাঠের চিত্র অত্যন্ত নাজুক। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের কথাই আগে বলি। সাংগঠনিক দুর্বলতা নাকি নৌকার দায়িত্বের বদলে প্রতিটি এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, ঠিক জানিনা, তবে একথা সত্য যে, মেয়রপ্রার্থীর নৌকার চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের অন্য প্রতীকের ঝনঝনানি বেশি। একটি ওয়ার্ডের সেন্টার কমিটির সম্পাদক জানালেন, পূর্ণ কমিটি এখনো না হওয়ায় গেল চারদিন ধরে সেন্টার কমিটির মিটিং হলেও চা খাওয়ানোর পয়সাটাও কেউ বের করে দেননি।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিযয়ে দেখা গেছে, ৪১ টি ওয়ার্ডের অন্তত ২০টিতেই ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিযয়ে খোদ প্রশাসনই আছেন টেনশনে।
কোন কোন ওয়ার্ডে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ঘটেছে জনআশার ঠিক বিপরীত চিত্র।
আলকরন ওয়ার্ডের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আওয়ামীলীগ নেতা তারেক সোলায়মান সেলিম কিংবা রামপুর ওয়ার্ডে এরশাদুল্লাহরা যখন মনোনয়ন পান না, তখন মাঠের সমর্থকদের হতাশ হতেই হয়। মাদক ব্যবসায়ী, চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাও যখন দলের মনোনয়ন পান তখন সাধারণ মানুষ হতাশ হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে পাহাড়তলীতে এক সময় বঙ্গবন্ধুর ছবি কুকুরের গলায় ঝুলিয়ে উপহাস করা নেতা যখন কাউন্সিলর মনোনয়ন পান তখন এ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু’র আদর্শের কর্মীদের মনে ঘৃণা না জাগার কোন কারণ নেই। এর পরেও নানামাত্রিক অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে রাজনীতি সচেতনদের মাঝে এ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। অবশ্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যারা এমন নির্বাচনের পরিকল্পনা করেন, তাদের কথা ভিন্ন। এমন বিরূপ চিত্রের সাথে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ উদ্বেগ যুক্ত হওয়ার পরেও তাদের তো ঘুম ভাঙছে না !
সব মিলিয়ে তাই প্রশ্ন রাখতেই পারি, ‘এই নির্বাচন আসলে কার স্বার্থে? সেবার, জনস্বাস্থ্যের, জনস্বার্থের, জনগণের, নাকি নিছক ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা ধরে রাখার? (কলামটি লেখা হয় ১৮ মার্চ ২০২০ইং)
লেখক: শব্দশ্রমিক