করোনায় করুণা কামনা

122

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

করোনা নিয়ে আমার গত লিখায় বলেছিলাম, রনি চীন থেকে কবে এলি-তাতেই সবাই পালিয়ে গেল। কিন্তু সেসময় দেশে সে পরিস্থিতি তৈরী হয় নি। এখন অবশ্য সে পরিস্থিতি দেশে পুরোদমে বিরাজ করছে, এখন যদি চিৎকার দিয়ে বলি, কলি ইতালি হতে কবে এলি? সাথে সাথে মাঠখালি, ঘরখালি, এলাকাখালি করে সবাই পালিয়ে যাবে। দোয়া করি আল্লাহ্ এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি দান করুন, আমিন। তবে শুনলাম কোন একজায়গায় বিদেশ থেকে স্বামী আসছে শুনে স্ত্রী পালিয়ে গেছেন, হা হা হা হা। এমন ভয়াবহ অবস্থায়ও হাসছি, কারণ আতঙ্কে মরে গেলে তো চলবেনা। আশা তো রাখতে হবে ভয়কে জয় করতে হবে, বিপদ কাটিয়ে উঠতেই হবে। গত লিখায় ইতালির একটি ঘটনা বলেছিলাম সোয়াইন-ফ্লু নিয়ে। বিচারক, গতকাল মেক্সিকো থেকে এলাম, বলতেই চিৎকার দিয়ে গোটা আদালত খালি হয়ে গেল সোয়াইন-ফ্লুর ভয়ে। অর্থাৎ রোগ সম্পর্কে তারা বড়ই সচেতন তাই বাহির হতেআসা কোন মানুষের সংস্পর্শে পর্যন্ত তারা আসেনি। ফলে ভাবছি দশ বছর আগে যারা রোগ নিয়ে এতই সচেতন ছিল,তারা আজ সোয়াইন-ফ্লুর বাপ করোনাকে নিয়ে কেন এত উদাসীন হল? আজ বিশ্বে করোনার এই ভয়াবহতাটা বলতে গেলে ইতালি থেকে। উৎপত্তি চীনকিন্তু ছড়াল ইতালি থেকে, আমাদের দেশেও এল সেই ইতালি থেকে।
সেদিন জাতীয় এক দৈনিকে দেখলাম ‘কন্ট্যাজিওন’ মুভিটির দর্শক বেড়ে গেছে। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১১ সালে, কিন্তু আলোচনার শীর্ষে আসে এখন। করোনা নিয়ে তাতে পূর্বাভাস আছে, ছবিতে সংক্রমণের শুরু চীনের হংকংয়ে, বাস্তবে চীনের উহানে। অতঃপর রোগের যেসব লক্ষণ দেখান হয়েছে বাস্তবের সাথে তা হুবহু মিলে গেছে। এমন কি কোয়ারেন্টিনের বিষয়টিও শয়ে শ মিলে গেছে। আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী- তাই প্রদর্শন বেড়ে গেল। তবে ছবিকে ভবিষ্যদ্বাণী বলতে নারাজ খোদ তার লেখক স্কট বার্নসই। তিনি বলেন, এমন ভাইরাস যে পৃথিবীকে যেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই তা বলেছেন। তাঁরা শুধু সেগুলোকেই তুলে এনেছেন।
ভাবুন কি মহৎ, পূর্বাভাসের ন্যূনতম কৃতিত্বের দাবী করলেননা। আমরা যদি হতাম এতক্ষণে ঢ্যাঁডড়া পিটিয়ে দিতাম, এলাকায় নতুন বাবা এসেছেন সবাই তাঁর আশীর্বাদ নিতে আসুন। পীর, দরবেশ, আউলিয়া বানিয়ে ফেলতাম, বাবা মহাগুরু জ্ঞানী আধ্যাত্মিকসম্র্রাট, ইলমে গায়েব জানেন সব বলে ফেলতে পারেন, মাশাল্লাহ্। তারপর শুরু হত আসন, ভাষণ ও শোষণ। আর এ কথাটিই করোনা বিষয়ক আমার বিগত প্রবন্ধে তুলে ধরেছি। আর দেখুন কেমন হুবহু কথাগুলো মিলে যাচ্ছে। বলেছিলাম গুজব, গজব আর আজাব শুরু হবে, ইতোমধ্যে সব আরম্ভ হয়ে গেছে। গো-মূত্র, গোবর খেয়ে অনেকে বাঁধিয়েও ফেলেছেন ডায়রিয়া, হাহাহাহা। তবে বার্নসের মতো আমিও কোন ভবিষ্যদ্বাণী করিনি, শুধু অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি- আমাদের স্বভাব।
এন্ড অব ডেজ; লেখক সিলভিয়া ব্রাউনি ও লিন্ডসে হ্যারিসন। ২০০৮ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পেঙ্গুইন পাব্লিশিং গ্রুপ থেকে কিন্তু বিক্রি বেড়ে গেছে এখন। বইটির এক পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ একধরণের নিউমোনিয়া রোগ সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে ও লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। এদ্দিন বইটির খবরই ছিল না, এখন শীর্ষ দশে উঠে এসেছে- এমনকি শীর্ষ একে চলে এসেছে। একেই বলে ভাগ্য, একেক জনের ভাগ্য একেক সময় খুলে যায়। তবে প্রশ্ন, এমন বরাবর মিলে কেমনে? উত্তর, লক্ষ লক্ষ লেখক কোটি কোটি কথা, হঠাৎ কারো সাথে মিলে গেল, তাই বলে অলৌকিকত্ব পেয়ে গেছে- এমন নয়। তাঁরা সে দাবী করেনও নি, সে দাবী করি আমরাই, ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে, হেহেহেহে। দেখুন না, ভারতে গো-মূত্র ও গোবর খাওয়াচ্ছে আর আমাদের দেশে রাস্তার পাশে করোনার ঔষধ বিক্রি হচ্ছে। স্বপ্নতত্ত¡ও বের হয়ে গেছে, যা ১ম পর্বে আমি উল্লেখ করেছি ‘বিবিধ ঘোষণা আসবে’ নামে। এসব কোন অলৌকিকত্ব নয় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, আর আমাদের স্বভাব আমরা না জানলে জানবে কে, হেহেহেহে। ফেবু, মিডিয়াতে দেখুন কি গুজবের ছড়াছড়ি, অনেক প্রতারকও বেরিয়ে গেছে, একেকজন একেকভাবে প্রতারণার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে দ্রব্য মূল্য বাড়া শুরু হয়েছে, মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার, ইত্যাদির দাম তো বেড়েছে কয়েকগুণ। খাদ্যদ্রব্য- চাল, ডাল, তেল, নুনের দামও বেড়েগেছে অনেক। পাওয়াই যাচ্ছেনা কিছু, এরমাঝে শুনলাম ভ্যাকসিন পার্টি বেরিয়েছে। পুশ করে বেহুঁশ বানিয়ে ঘর খালি করে দিচ্ছে, ফলে সাবধান কাউকে ঘরে ঢুকাবেন না।
খবর পেলাম ট্রাম্প করোনা পরীক্ষা করাতে রাজি হয়েছেন। হাহাহা, তাহলে তিনিও শঙ্কিত ও সংশয়িত। আহা- আমাদের অনেককে প্যাথলজিকেল টেস্ট করাতে বললে ভয়ে করি না। কারণ রোগটি যদি হয়ে যায় তখন কি হবে? নারে বাবা না জানাতে আছি ভালই আছি, জেনে গেলে তখন আবার চিন্তা বেড়ে যাবে। জেনে মরার চেয়ে না জেনে হুট করে মরে যাওয়া অনেক ভাল, জেনে গেলে চাপ বেড়ে যায়। মনে হয় ট্রাম্পেরও সেই দশা, হাহাহা। আসলে আর দশটা ভাইরাসের চাইতে করোনা সম্পূর্ণ আলাদা, দ্রুত নিজেকে সে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারে, তাই ঝুঁকিটা কিছু বেশী। নামের অর্থটাও আরেক মজার- পুষ্পমুকুট। কানার নাম পদ্মলোচন আর কানির নাম সুনয়না, হাহাহাহা। নামের বড়াই করোনাকো নামদিয়ে কি হয়, নামের মাঝে পাবে নাকো সবার পরিচয়। তারপরও মুকুট পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাচ্ছে- একাম করোনা, করোনা করুণা করেনা।মানে মানে ঘর ধর, নাহলে জানে মর।দয়া করে বিদেশ ফেরত কেউ ঘরের বাহির হবেন না। বের হয়েই দ. কোরিয়ায় ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা ৭৮৮০ জনকে সংক্রমিত করে ফেলেছেন। তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে পেশেন্ট থার্টিওয়ান সুপার স্প্রেডার। আবার দেখি এথেন্সে একযুবক থুথু মেরে চৌদ্দ পুলিশকে কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। যুবকটি ছিল করোনাভাইরাস পজিটিভ, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করায় সে তাদের থুথু মেরে দিয়েছে, হেহেহে। বিদেশ ফেরত শুনলেই সবাই দৌড়ে পালায়।
একসময় কলেরা, বসন্ত, প্লেগে বিশ্বে বহু মানুষ মারা যেত, এখন আবার পৃথিবীজুড়ে সেই আতঙ্কের ডঙ্কাধ্বনী শুনা যাচ্ছে। কথা হল সেইঅনগ্রসর সভ্যতার বিশ্বে রোগগুলো মহামারী আকার ধারণ করেছিল, সেই কথা মানা যায়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর উন্নত যুগে একটি তুচ্ছ ভাইরাস এমন মারণরূপ পরিগ্রহ করবে তা মানি কেমনে? তুচ্ছ বলার কারণ চীন তাকে বশ করেছে, যে চীনে তার উন্মেষ সে চীনাই করেছে বিনাশ। তাহলে পরাক্রমশালী ইউরোপ সহ বাকী বিশ্ব কেন পারলনা? তাতে রয়েছে মূল শিক্ষার ফুল রহস্য এবং তা অবহেলা।
অতএব ভুল চলবেনা, যারা বলে আমরা করোনা থেকে শক্তিশালী, যতদিন পর্যন্ত অমুক আছে, করোনা ভাইরাস আমাদের কিছুই করতে পারবে না- সেসব আবালদের শাবল মেরে ঠিক করতে হবে। ব্রেকছাড়া বকবক করো না। এই ব্রেকছাড়া বকর-বকর করেই নাকি ট্রাম্প আমেরিকার অবস্থা কাহিল করে ফেলেছেন, হাহাহা।দেশে এখন করোনা-পথ্যের ছড়াছড়ি, ফেবু-মিডিয়া দেখলে মনে হয় দেশে ডাক্তারের অভাব নেই। বীরবলকে আকবর জিজ্ঞেস করলেন, বলতো দেশে কোন পেশার লোক বেশী? বীরবল; জাঁহাপনা ডাক্তার। সম্র্রাট বিশ্বাস করলেন না। বীরবলের কদিন দেখা নেই, সম্র্রাট সহ সবাই বলাবলি করছেন, বীরবল কোথায়, বীরবল কোথায়?তারপর বীরবল যখন এলেন সম্র্রাট; কি বীরবল এদ্দিন কোথায় ছিলে?বীরবল; জাঁহাপনা অসুখ করেছিল। কি অসুখ? সর্দি।
বীরবলের উত্তর শুনে প্রাসাদসুদ্ধ সবে হেসে উঠলেন, আরে এটি কোন অসুখ নাকি?নাকের ভেতর শলা একটি দিয়ে সুড়সুড়ি দিলেই তো সর্দি ভাল হয়েযায়। কেউ বলেন সর্ষেতেল, কেউ অমুক, কেউ তমুক, ইত্যাদি অনেক পথ্য। বীরবল তখন করজোড়ে; জাঁহাপনা প্রমাণ হল তো এখন আপনার দেশে ডাক্তার বেশী? সেই ডাক্তারীর দরকার নেই। ডে বাই ডে ভাইরাসগুলি তাদের চরিত্র বদল করছে, দিনে দিনে আরোমারাত্মক হচ্ছে। হতে পারে ভবিষ্যতে তারা গোটা সভ্যতা ধ্বংস করে দেবে, মনে হচ্ছে তা পরিবেশ দূষণের ফল। সুতরাং সতর্ক হতে হবে, পরিবেশ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে, ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে হবে। করোনার কাছে করুণা নয়, করোনাকে করতে হবে জয়।
করোনা আজ পরাশক্তি আর কোটিপতিদের জন্য এক সতর্কবার্তা। কি হবে এত সম্পদ গড়ে, এত অস্ত্রের পাহাড় বানিয়ে? সে সম্পদ সে অস্ত্র কি পেরেছে আজ তোমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য ঘুরিয়ে আনতে? আজ ট্রাম্প, মার্কেল, এলিজাবেথ, পুতিন সহ প্রভাবশালী সব সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ গৃহবন্দী। কেউ বেরুতে পারছে না, রাণী নাকি প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, হাহাহা। অবশ্য ভাল করেছেন কারণ তাঁর ছেলের হয়ে গেছে। পৃথিবী আজ অবরুদ্ধ ক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের কাছে। এখানেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত শিক্ষা চিন্তাশীলদের জন্য। মানসিকতা পরিবর্তন কর, মানবকল্যাণে, বিশ্বকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত কর। পরিবেশ রক্ষায় মনযোগী হও সম্পদের পাহাড়গড়ো না, অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ কর। নাহলে করোনা কাউকে করুণা করবে না।
আল্লাহ্ শুধু আপনিই আমাদের করুণা করুন। স্বাধীনতার মাসে বাংলা নয় শুধু সারা বিশ্বকে আজ প্রকৃতই জেলখানা বলে মনে হচ্ছে এবং মনে সে কারণে প্রচুর শান্তি পাচ্ছি। ভরা থেকে খালি ভাল যদি ভরতে যায়, যাওয়া থেকে আসা ভাল যদি ডাকে মায়, মুক্তি থেকে বন্দি ভাল যদি করোনায় পায় । অতএব সবাই বন্দি থাকুন, শান্তিতেই থাকুন। শুনলাম জাপান ভ্যাকসিন বানিয়েছে- আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ্ কবুল করুন, আমিন। কিন্তু এমন দুর্যোগে সরকার খালেদা জিয়াকে কেন মুক্তি দিল বুঝলাম না। মানুষের ঢলে লক ডাউন তো ব্রেকডাউন করেছে। বলা হল খালেদার প্রতি করুণা…।

লেখক : কলামিস্ট