করোনায় করুণা কামনা কেউ করোনা!

204

সেইদিন এক জায়গায় গিয়ে দেখি তুমুল মারামারি, লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস হয়ে যাবে অনেক শেষ। এত বারণ করি কেউ থামে না। চিৎকার দিয়ে তখন, রনি চীন থেকে কবে এলি, বলেই দৌড়। ওমাÑ পেছন ফিরে দেখি একটি মাছিও নাই, সব ফাঁকা,হাহাহাহাহা। এতক্ষণ ধরে এত লোকের প্রচেষ্টায় যা হয়নি, ঐ একটিমাত্র কথার কেরামতিতে সবকিছু অবসান। আসলে প্রত্যুৎপন্নমতি তথা উপস্থিত বুদ্ধি একটি বড় বিষয়, সেদিনের আমার সেই উপস্থিত বুদ্ধির জোরে অনেক মানুষ অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেল। তবে আমার যে তত বুদ্ধি আছে তা কিন্তু নয়, আসলে এখানে আমি ইটালীর আদালতের একটি অভিজ্ঞতাকে পরীক্ষামূলক কাজে লাগিয়েছি। দেখি কোরামিনের মত তা কাজ দিয়েছে, করোনাকে মানুষের এত ভয়! হওয়ারও কথা, কারণ প্রতিদিন সংবাদে, মিডিয়ায় যেভাবে আসছে ভয় না পেয়ে উপায়ও তো নাই। তবে আমার কেন মনে হয় করোনা যত না বিনাশক তারচে বেশী ভয়ানক।
সম্ভবত ২০০৯/১০’র কথা, বিশ্বজুড়ে সোয়াইন ফ্লু তখন প্রচন্ড দাপট নিয়ে দাপাচ্ছে। উৎপত্তি ছিল তার কিন্তু মেক্সিকোতে, প্রচুর প্রতাপ তার তখন সেখানে। মেক্সিকো বলতেই মানুষ তখন ভয়ে কেঁপে উঠত, এখন যেমন চীনের নাম শুনে কেঁপে উঠছে। করোনার মত সোয়াইন ফ্লু’রও লক্ষণ হলো সর্দি-কাশি, প্রচন্ড সংক্রামক। ইটালীর এক বিচারপতি সবেএজলাসে উঠলেন, আদালতকক্ষ লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ বিচারক সাহেবের কাশি আসল, ঝেড়ে কেশে তিনি নাক মুছতে মুছতে, ‘আল্লাহ্ই জানেন কি হলো? কালমাত্র মেক্সিকো থেকে এলাম।’ ব্যস অদ্দূরেই কাম শেষ বিকট চিৎকার দিয়ে আদালতকক্ষ করে খালি বিচারককে দিয়ে গালি সবাই ছুটে পালাল। মনে পড়তেই তা নগদে এখানে কাজে লাগিয়ে ফেললাম আর সাথে সাথেই ফল দিল। কিন্তু এখন দেখছি কেউ কেউ সিস্টেমটা ব্যাংকে গিয়ে এ্যাপ্লাই করার তালে আছে। লেনদেনের চরম মুহূর্তে একজন গিয়ে ব্যাংকে কাশি দিয়ে নাক মুছবে আরেকজন তখন বলে উঠবে, ‘কিরে শাহেদ চীন থেকে কবে এলি?’ সাথে সাথে ব্যাংক খালি তারা হবে তার মালি, খোঁজবে সদা জুঁই-চামেলি।
শেষেরটা যদিও ধারণা তবে অমূলক কিছু না। এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, হুজুগের সুযোগ সবাই কিন্তু গ্রহণ করে কেউ ছাড়ে না। কথায় আছে কারো সর্বনাশ কারো পৌষমাস, ঝড়-তুফান, জলোচ্ছ¡াসের সময় আমরা দেখি কেউ জান বাঁচাতে ব্যস্ত, কেউ মাল লুকাতে ন্যস্ত। ঘোলাজলে মাছ শিকারের ন্যায় বিপদাপদ, দুর্যোগে কাউকে কাউকে দেখা যায় লুটপাটে নিয়োজিত হতে। সুযোগ কিংবা দুর্যোগকে একেকজন একেকভাবে কাজে লাগায় ও স্বার্থসিদ্ধি করে। কিন্তু ভেবে কূল পাচ্ছিনা লাল এক টাকাকে হাজার টাকায় কিনে তারা কি স্বার্থটা সিদ্ধি করল এবং কিভাবে করল? কেন তারা সেই টাকাটা হাজার টাকা দিয়ে কিনল এবং কি উদ্দেশ্যটা সাধন করল। আশ্চর্য দশ টাকার শেয়ার হাজার টাকায় বিক্রি হয় যে দেশে, এক টাকার কয়েন হাজার টাকায় কেনা হয় যেখানে, চীনের কথা বলে ব্যাংক খালি করে ফেলা কোন ব্যাপারই নয় সেখানে। অনেক ঘটনাই তো ঘটছে প্রতিদিন এখানে, ইঁদুর বাঁধ খেয়ে ফেলে, ঝাঁকুনি দিলে ভবন পড়ে যায়। সুতরাং করোনা এলে ধারণা যাবে চলে, জ্ঞান হারিয়ে সবাই তখন পড়বে ঢলে।
ফন্দির শেষ নাই, এতদিন জানতাম হাইজ্যাক পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি। এখন শুনছি সালাম পার্টি, এসে মক্কেলকে নাকি সালাম দিয়ে কাম করে দেয়। আশেপাশে অনেক মানুষ রয়েছে কিন্তু কেউ কিছু জানেও না, বুঝেও না হাহাহাহা। আসলে প্রতারণার ধরণের শেষ নাই, ধরুননা ১৯৯১’র ২৯ এপ্রিলের সাইক্লোনের কথা। যাদের সেকথা মনে আছে তাদের নিশ্চয় তার দুইদিন পরের রাত দুইটার ভূমিকম্পের কথাও মনে আছে। বস্তুত ভূমিকম্প তো হয়নি, কিন্তু সাইক্লোনের দু’দিন পর রাত দু’টায় হঠাৎ চাউর হয়ে গেল ভূমিকম্প হবে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যান। শুনে আমরা পড়ি কি মরি দৌড়ে বের হয়ে রাস্তায় চলে আসি। তারপর দু-চার ঘর খালি হয়ে যাওয়ার পর মাথায় বুদ্ধি এলো আরেÑ ঘূর্ণিঝড়েরই’না পূর্বাভাস হয় ভূমিকম্পের তো হয় না! এই কাম করল কে, এই কথা বলল কে, এ বোমা ফাটাল কে? চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, ততক্ষণে সব শেষ, যারা ঘরের মাল হারাল তারা মাথায় হাত মারিল। কিছুই করার ছিল না, হাহাহাহা। কি যে বলব দুঃখের কথা, ফন্দিবাজরা আতঙ্ককে পুঁজি করে ধারণার বাইরে নানা রকম মতলব আঁটে।
চট্টগ্রাম শহরে বাটপারদের সুতিকাগার হলো স্টেশন রোডের নিউমার্কেট মোড়। সাবেকজলসা সিনেমা ভবন হতে নূপুর সিনেমা ভবন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ফুটপাথ ব্যাপী তাদের অবস্থান। বড় ডেঞ্জেরাস জোন এটি যারা জানেন না তারা বুঝতেই পারবেন না কি জঘন্য জায়গা সেটি। তথাকার মোবাইল, চশমা, ঘড়ির দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে তাদের ধাপ্পাবাজি। খপ্পরে পড়লে তাদের নিরীহ পথচারী একদম সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। একদিন সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সিটি কর্পোরেশন মার্কেটের নিকট আসতেই দেখি সবল একলোক দুর্বল হতাশ গোবেচারা একলোকের ঘড়ি ধরে টানাটানি করছে। সবল বলছে পাঁচহাজার টাকা দেব, দুর্বল বলছে হবে না। মনে হলো সবল জোর করে তার থেকে ঘড়িটা নিয়ে নেবে, দুর্বলের চেহারা দেখে আমার একটু মায়া হলো তাই দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখতে লাগলাম। ঠিক তখন দুর্বল এসে আমাকে, ‘স্যার আমি কলেজের প্রফেসর ফ্যামিলি নিয়ে সিলেট থেকে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছি, টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি যেতে পারছিনা। দয়া করে আপনি ঘড়িটা নিলে আমার উপকার হবে।’ আমি দাম জিজ্ঞেস করলে বলে, আপনি নিলে তিন হাজার টাকায় দিয়ে দেব।
আমি অবাক হলাম বললাম, তাকে ৫ হাজারে দিচ্ছ না আমাকে ৩ হাজারে কেন দেবে? বলে, সে খারাপ ব্যবহার করেছে, জোর করেছে তাই দিচ্ছি না। তখন সবল এসে আমাকে বলে, ‘স্যার নিয়ে নিন রাডো ঘড়ি, ৬০ হাজার টাকা দাম। দরকার হলে আপনি কিনে আমার কাছে বিক্রি করেফেলুন আমি ৫ হাজার টাকায় কিনে নেব।’ আমি তখন বলি, ঠিক আছে টাকা এনে দাও আমি কিনে তোমাকে দিয়েদেব। সে বলে, আমার হাতে টাকা নেই আপনি নিন আমি এনে দিচ্ছি। আমি বলি, আগে ৫ হাজার টাকা আমার হাতে এনে দাও। ঠিক সে সময় দেখি দুজন লোক এসে, স্যার একটু এদিকে আসুন বলে কিছু ভেতর দিকে নিয়েগেল আমাকে। সেখানে দেখি আরো দুজন লোক ফয়সালা করার ঢঙে, স্যার এটি রাডোঘড়ি ৬০ হাজার টাকা দাম, আপনি কত দেবেন? আমি বলি কিনব না। তারা; দুই হাজার দেন, একহাজার দেন। আমি তখন রূঢ় কণ্ঠে, এক টাকাও দেবোনা। তখন একজন জিজ্ঞেস করে, স্যার আপনার বাড়ি কোথায়? আমি বলি আলকরণ, উল্টাপাল্টা করবি সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাব। মনে হয় ভয় পেয়েছে তাই সরে গেল আমি চলে এলাম।
দুই দিন পর সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি সবল আর দুর্বল মিলে বিড়ি টেনে টেনে খোশগল্প করছে! মেজাজ এমন ধরা ধরল, ইচ্ছে হলো দুই থাপ্পড় মারি। ভাবলাম ঠিক হবে না, আমি একা উল্টা সবাই মিলে আমাকে দিবে। ঠিক করি পুলিশকে বলে ধরিয়ে দেই। কিন্তু না সেটিও হবে না, কারণ তাদের সাথে পুলিশের লাইন ফলে দেখা যাবে আমাকেই ধরে ভরে দেবে, হাহাহাহা। বুদ্ধি করে নিরাপদে চলে এলাম, ভাবুন এবার বাটপারীর রকমফের। আপনাদের কাছে দায়বদ্ধ বিধায় ঘটনাটা একটু বিস্তারিত বললাম। হাজারী গলিতেও এমন কিছু বাটপার আছে যারা দোকানের বাইরে বারান্দাতে বসে স্বর্ণ কেনাবেচা করে। আপনি স্বর্ণ বিক্রি করতে গেলে দোকানের চেয়ে অনেক বেশী দাম দিয়ে তারা তা কিনবে, কিনতে গেলে অনেক কম দাম দিয়েই বেচবে। কিন্তু ওজনে এমন মাইর দিবে দোকানের অর্ধেকও পাবেন না! অতি ভয়ঙ্কর তারা নকলও ধরিয়ে দেয়, মানুষকে একদম চেঁছে ফেলে, ফলে সাবধান তাদের থেকে। ধান্দাবাজি করে কিছু লোক মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা করে। আসলে প্রতারকরা ভীষণ হিং¯্র হয়, তাদের মনে দয়া-মায়া নাই। মানুষের বিপদকে পুঁজি করে তারা রুজি ধরে। করোনা যেহেতু মহামারি রূপ ধারণ করেছে, বিশ্বে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে তাই তা নিয়েও বহুজন ধান্দা করতে পারে।
এখন অনেকে হয়তো বলতে পারেন, তুমি বাপু বড় অগ্রিম চিন্তা করো, এমন প্রতারণা করোনাকে নিয়ে কেউ কখনো করবে না। তাদের জন্যে বলে রাখি, ঘোষণা কিন্তু ইতোমধ্যে এসে গেছে মহাগুরু নিত্যানন্দের কাছ থেকে। লিখা শেষ করতে পারিনি তম্মধ্যেই সে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে, ওম নিত্যানন্দ পরম শিবম, জপলে করোনা সেরে যাবে। ভাবছি লিখা বাহির হতে হতে হয়তো এমন কোন ঘোষণা এসেযাবে যা সমরখন্দ আর বোখারার ঘোষণাকে সহ হার মানাবে। সেই ঘোষণা ছিল হাফিজের, ‘প্রিয়ার গালের কালো তিলটির জন্য বিলিয়ে দেবো সমরখন্দ আর বোখারার মত সমৃদ্ধ রাজ্য।’ মাশাল্লাহ্ বড়ই প্রেমিক পুরুষ তাই তা বলতে পেরেছেন। এবার আসবে বড়ই প্রেষিক পুরুষ, আপনাকে একশ কদম পাঠিয়ে গোটা উদম করে দেবে। এসে ঘোষণা দেবে, ‘করোনা থেকে বাঁচতে চাইলে এখন চোখ বন্ধ করে একশ কদম যা, পেছনে তাকাবি না তাহলে মরবি।’ আপনি ভয়ে যাবেন চলি, এসে দেখবেন আলমারি খালি আপনি হলেন বলি, দেবেন বসে গালি। হাফিজ চেয়েছেন দিতে এরা চাইবে নিতে, হেহেহেহে।
অতএব আসুন আমরা আতঙ্কিত হবো না, কারো করুণা চাইবনা। সতর্ক হব এবং সাহসের সাথে বিপদকে মোকাবিলা করব। প্রার্থনা করব, আল্লাহ্ আমাদের বিপদ হতে রক্ষা করুন, আমিন। তবে দুঃখ যা ভাবলাম তা হলো, ছেলের করোনা হয়েছে, তাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরেফেলা হবে। এমন গুজব ছড়াতে সাতক্ষীরায় এক মা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন। দোয়া করি এমন আর না হোক। শুনা যাচ্ছে গরম এলে করোনা নাকি থাকবে না, গরমে তা টিকে না। ওমাÑ এ তো দেখছি আমাদের মশার মতো, কিছুতেই যায় না কিন্তু বর্ষা এলে থাকে না, হাহাহাহা। ম্যানুয়েলে হলো না ন্যাচারেলেই রক্ষা, ফলে আর ভয় নাই পেতে হবে না অক্কা। আমাদের দেশ তো এমনিতে গরম, করোনাকে তবে আর কিসের এত শরম? শুরুতেই বলেছিলাম না, ভয় নাই সাহস চাই? তাই করুণা নয় ধারণা জয় করোনা লয়।
লেখক : কলামিস্ট