করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মাস্ক পরিধানে ভ্রান্ত মনের এলার্জি পরিহারের অভ্যাস করা

37

সঞ্জয় চৌধুরী

চারিদিকে করোনার বিষাক্ত তীব্র ফনায় আজ জনজীবন বিপর্যস্ত। বর্তমানে দৈনন্দিন মৃত্যুহার ও নতুন সনাক্ত হারের হিসাব গ্রাফে উর্ধ্বদিকে ধাবমান।কখন গ্রাফের সেই উর্ধ্বগামী রেখা নিম্নগামী হবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানেন না। এমন এই অবস্থায় দেশের হাসপাতাল গুলোতে সরজমিনে দেখা যায়, সেখানে মাত্রাতিরোক্ত রোগীর কারণে তিল ধারনের ঠাঁই নেই। ফাঁকা নেই কোন আইসিইউ। প্রবল সংকটের মধ্যে সাধারণ শয্যা পেতে হিমসিম খাচ্ছেন রোগীরা। পর্যাপ্ত বেড না থাকায় নিয়মিত অনেক রোগীকে ফেরত যেতে হচ্ছে। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা ও সাত দিন ব্যাপী লকডাউন জারী করেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের ধারনা অনুযায়ী যদি এই সময় বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি সমূহ মানা না হয় তবে আমাদেরকে আরো ভয়ংকর পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হবে। এই স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধির অন্যতম হল দেশের সকল নাগরিকের মাক্স পরিধান নিশ্চিতকরণ। কিন্তু আমরা কি এখনো সকল নাগরিকের মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে পেরেছি? উত্তরে বলতে হয় নিশ্চয়ই না।
রাস্তাঘাটে নামলে লক্ষ্য করা যায়, এমন কিছু লোক আছে যারা মাস্কের কাছেও নাই, আবার অন্যদিকে এমন কিছু লোকের মুখমÐলে মাক্স দেখা গেলেও তা নাক ও মুখের নীচে আটকিয়ে রেখেছে। এই অবস্থা কেন জিজ্ঞেস করলে অনেকে উত্তর দেয়, শরীরে এক ধরনের অস্বস্তি লাগে। আবার অনেকে উত্তর দেয় মনে হয় দম যেন বন্ধ হয়ে যাবে। আসলে এটি মনের এলার্জি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ প্রসঙ্গে আমার জীবনের একটি বাস্তব উদাহরণ আমি আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই। করোনার আগেকালীন সময়ে অনেকে ধুলাবালি ও গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে রক্ষার জন্য মাস্ক পরিধান করতেন। সেই হিসেবে তখনকার সময়ে আমি যখন আমার মাকে সাথে নিয়ে বের হতাম তখন উনিও ধুলাবালি এবং গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে রক্ষার জন্য মুখে মাক্স পরিধান করতেন এবং সঙ্গে আমাকেও পরিধান করতে বলতেন। মায়ের অনুরোধ রক্ষার্থে আমি সেদিন মাস্ক পরিধান করার জন্য যখন চেষ্টা করতাম তখনি আমার কাছেও মনে হত শ্বাস প্রশ্বাস হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। খারাপ লাগলে যখন খুলে ফেলতাম তখন মা এই বলে আমাকে সান্তনা দিতেন দেখ এইভাবে প্রতিদিন চেষ্টা কর এবং মাস্ক পরিধান কালীন সময়টা ক্রমান্বয়ে বাড়াতে থাক। দেখবে একদিন তুমিও আমার মত মাস্ক পরিধানে অভ্যস্ত হবে। এরপর থেকে আমি আমার সাধ্যমত মাস্ক পরিধানের অনুশীলন শুরু করলাম। এর মধ্যে মা পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। অন্যদিকে গত ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন কোভিড-১৯ ভাইরাস দেশব্যাপী হানা দিল তখন সবাইকে মাস্ক পড়তে দেখে আমার মনে সাহস আসল যে, মা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে আমি তো মাস্ক পরিধানের চর্চা করেছিলাম। এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আমি মাস্ক পরিধান শুরু করলাম। প্রথমে একটি মাস্ক পরিধান করলেও অনেকের দুইটি মাস্ক পরিধানের দৃশ্য দেখে আমিও এক সঙ্গে দুইটি মাস্ক পরিধান শুরু করে দিলাম। এভাবে করোনা সংক্রমনের সময়কাল থেকে এ পর্যন্ত মাস্ক পরিধান করে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছি। এখন ঘর থেকে বের হলে ভুলে মাস্ক যদি ফেলে যায় মনে হয় আমার দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে কি যেন হারিয়ে গেল।
আমার জীবনের এই পরিবর্তন থেকে আমি নির্বিধায় বলতে পারি,মানুষ অভ্যাসের দাস নই, অভ্যাসই মানুষের দাস। মনের মনমানসিকতাকে যারা পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর তাঁদের কাছে এই বৈশ্বিক মহামারীতে একমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবে মাস্ক পরিধানে অভ্যস্ত হওয়া পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে কোন কঠিন ব্যাপার নই বলে আমি মনে করি।সদিচ্ছায় মানুষকে যে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে সক্ষমতা সৃষ্টি করে তা আরেকটি ঘটনা থেকে আপনাদের বোঝানোর চেষ্টা করব। করোনা সংক্রমনকালীন সময়ে আমি একবার সিএনজি যোগে কর্মস্থলে যাচ্ছিলাম। সিএনজিতে উঠে দেখি মাস্ক ড্রাইভারের মুখের নিচে আটকানো অবস্থায় আছে। এই দৃশ্য দেখে আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে ভাই মাস্ক তোমার মুখের নিচে কেন? এতে ড্রাইভার আগের সেই উত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটালো অর্থাৎ মাস্ক পরিধান করলে যেন মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভারের মনের এই এলার্জি দূর করার জন্য আমি একটি কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে তাকে বললাম দেখ তুমি ঠিক ভাবে মাস্ক পরিধান কর নচেৎ আমি তোমার সিএনজি থেকে নেমে যাব। তখন ড্রাইভারের মনে হয়তো বা এই ভাবনা আসল যে, আমি যদি সিএনজি থেকে নেমে যায় তাহলে তার ভাড়াটা নষ্ট হবে এবং এতে সে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এরপর দেখি ড্রাইভার নিজে নিজে পরিধানরত মুখের নিচের মাস্ক উপরে তোলে দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করল।নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছার পর তার হাতে নির্দিষ্ট ভাড়া ও সঠিক ভাবে মাস্ক পরিধানের জন্য কিছু বকশিস দিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম কিরে ভাই সঠিক ভাবে মাস্ক পরিধানের পর সত্যি সত্যি দম বন্ধ হয়েছে কিনা? প্রত্যুত্তরে ড্রাইভার মৃদু হেসে উত্তর দিল আসলেই বার বার চেষ্টার মাধ্যমে কোন কঠিন কাজকেও সহজ করা যে সম্ভব তা আপনি আজ আমাকে শিখিয়ে দিলেন এবং আমি আজ আপনার সামনে এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম যে,করোনা নির্মুল না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী মাক্স পরিধান করব।
এতক্ষন আমার জীবনের এই ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো মাস্ক পরিধানে যাদের এ রকম মনের এলার্জি আছে চেষ্টা ও অনুশীলনের মাধ্যমে তা দূর করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। পরিশেষে সবার প্রতি আমার এই অনুরোধ থাকবে করোনার এই তীব্র সংক্রমনে মনের এলার্জিকে দূরীভূত করে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক মাস্ক পরিধান সহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্যান্য নিয়মকানুন সমূহ মেনে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার মাধ্যমে দেশকে সুরক্ষিত রাখবে আমি এই আশাটুকু ব্যক্ত করছি।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট