করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা সতর্কতা জরুরি

34

 

ঋতু পরিক্রমায় শীতের মাস পৌষ ও মাঘ হলেও কার্যত এর ব্যাপ্তিকাল আরও দীর্ঘ। নভেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতের মৌসুম। যদিও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে শীতের প্রকৃত রূপ প্রকৃতিতে যেভাবে প্রতিফলিত হওয়ার কথা তা অনেক সময় সেভাবে হয় না। তবে এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় শীতের প্রাবল্যও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেশি। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে শীতের জন্মমাস ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। বয়োজ্যেষ্ঠদের ধারণা থেকে আমরা বুঝতে পারি শীতের শুরু ভাদ্র মাসে এবং শেষ ফাল্গুন মাসের প্রথম পক্ষে। তবে শীতের আগমনী বার্তা শীতের মূল সময়ের অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। হেমন্তের শুরুতেই ধানক্ষেতে বা ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর দেখা মেলে। এ কারণে অনেক আগে শীতকালকে বলা হতো শিশির। তারও আগে পৌষ ও মাঘ মাসকে বলা হতো হিম ঋতু। শিশির পরবর্তীতে শীতকাল আর শিশির হেমন্তকাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাংলাদেশে শীতের সকালের দৃশ্য বড় রূপময়, তবে এ রূপময় দৃশ্য শহরে কদাচিৎ দৃশ্যমান হয়—উপভোগ করাতো দূরের কথা। এ অপরূপ দৃশ্য দেখার ইচ্ছে যদি কারো হয় তাহলে আপনাকে একবার রবিঠাকুরের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলোতে যেতে হবে। অথবা যেতে পারেন জীবনানন্দের ধানসিঁড়িটির তীরে। তাও যদি সময় করে উঠতে না পারেন অন্তত একবার যেতে পারেন আল মাহমুদের কর্ণফুলির কূলটায়। যত দূর চোখ যায় দেখতে পাবেন একটা বিশাল সাদা চাদর আর সেই চাদরের নিচে ঘুমিয়ে আছে আদিগন্ত জনপদ। সে বিশাল সাদা চাদর ভেদ করে এক সময় সূর্য উঁকি মারে। সেই উঁকি মারার মুহূর্তটা কী যে অপূর্ব তা মোটেই ভুলবার মতো নয়, ঠিক যেন তা-মগডালে কাঁচা রোদ করে ঝিকিমিকি’র মতো। দূর্বাঘাসে, ফুলে ফলে রাতে জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো মিষ্টি রোদে স্বচ্ছ মুক্তোদানার মতো মনে হয়। এ কারণে শীত অন্য ঋতুর চেয়ে ভিন্নমাত্রা বহন করে, যা ঋতু বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শীত ঋতু তাই সুখ ও ভোগের ঋতু। বিচিত্র ফুল, ফল, রঙিন শাক সবজি, খেজুর রস, রকমারি পিঠাপুলি সর্বোপরি পরিযায়ী পাখির অবাধ স্বাধীনতার ঋতু শীত।
শীত ঋতু সুখ, ভোগ ও পরিযায়ী পাখির সৌন্দর্যের আধার হলেও এ ঋতুর অসুখ তথা দুর্ভোগের কিন্তু কমতি নেই। প্রকৃতির বুকে যতটা আর্দ্রতা থাকে তার সবটুকু চুষে নেয় শীত। ফলে আর্দ্রতা হারিয়ে প্রকৃতি হয়ে ওঠে রুক্ষ ও শুষ্ক। গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। মাঠে-ঘাটে সবুজের হাতছানি চোখে পড়ে না। প্রকৃতি যেন হয়ে পড়ে প্রাণহীন। শুধু উদ্ভিদ জগতে নয়, জীব জগতেও শীতের রুক্ষতা ও শুষ্কতা আরও প্রকট রূপ ধারণ করে। মানব শরীরের ত্বক আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে। কারো ঠোঁট, কারো পায়ের তালু গ্রীষ্মের মাটি ফেটে চৌচির হওয়ার মতো হয়ে যায়। আর শীত যদি তীব্র আকার ধারণ করে তাহলে আর কারো রক্ষে নেই। শীতের তীব্রতা বাড়লে জনজীবন ব্যাহত হয়। তাপমাত্রা যত কমতে থাকে মানুষের দুর্ভোগও তত বাড়তে থাকে। প্রচÐ ঠাÐায় মানুষ অনেক সময় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এ অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও অশীতিপর মানুষেরা।
বিশেষত শীতের শুরুতে কিংবা তীব্র শীতে জনজীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে তার জন্যে আগেভাগে প্রস্তুতি থাকা দরকার। দাপুটে শীতে কাবু হয়ে মানুষ কাঁপতে থাকে ঠক ঠক করে। জনজীবন হয়ে পড়ে স্থবির। যাদের পাকা বাড়িঘর, গরম কাপড় চোপড় আর লেপ কাঁথা রয়েছে তাদের কোন কষ্ট হয় না। তাদের জন্য রাতের ঘুম হয় খুব আরামের, খুব আয়েশের। কিন্তু যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা তাদের দিনকাল হয়ে পড়ে কাহিল। দেশের উত্তরাঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে শীতের তীব্রতা বেশি হয়ে থাকে। এসব এলাকায় গরম কাপড়ের অভাবে অশীতিপর মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ সময় ছোটদের অবস্থা হয় আরও করুণ।
পুরো শীতকাল জুড়ে ছোটদের পাশাপাশি বড়রা নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তারমধ্যে রয়েছে সাধারণ সর্দিজ্বর, কাশি, ব্রংকাইটিস, টনসিলের প্রদাহ, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগ। এমনকি সাধারণ সর্দিজ্বর থেকে তীব্র ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া বা নাকের সংক্রমণেরও ঝুঁকি থাকে।
শীতকালের এসব অসুখ বিসুখের সঙ্গে গত বছর থেকে যুক্ত হয়েছে প্রাণঘাতি রোগ কভিড-১৯। গত বছরের শীতকালে করোনার প্রকোপ মোটামুটি সহনীয় পর্যায় থাকলেও এ বছরটা কেমন যাবে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে সময়টা আমাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় আরামের ঘুম হারাম করে দিতে পারে করোনার ছোবল। গত দুই এক মাস ধরে করোনায় সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তা যে কোন সময় মাথা চাটা দিয়ে যে উঠবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। ইতিমধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধির আলামত আমাদের প্রতিবেশি দেশে বলতে গেলে আমাদের পাশের বাড়িতেই ক্রমেই পষ্ট হয়ে উঠছে।
স¤প্রতি একটি স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘প্রতিবেশি দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। বিষয়টি মাথায় রেখে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশে। এ কারণে তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলায় নতুন করে প্রস্তুতির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। করোনা ব্যবস্থাপনায় গঠিত ওয়ার্ড কমিটিকে অধিকতর সক্রিয় করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তরফে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। এ নিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ইউনিয়ন পরিষদের কাছে নির্দেশনা সম্বলিত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।’(দৈনিক পূর্বদেশ, তাং ০৫/১১/২০২১)। বাংলাদেশে বর্তমান সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তা যে কোনো সময় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারে। বৈশ্বিক মহামারির ধরনটাই এমন যে প্রতিবেশি দেশগুলোর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে আপনি কখনো নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত বলতে পারেন না। বাংলাদেশে ৩ নভেম্বর করোনা শনাক্ত হয় ২২৯ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৩ জন। ৪ নভেম্বর করোনা শনাক্ত হয় ২৫৬ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৭ জন। ৫ নভেম্বর করোনা শনাক্ত হয় ২৪৭ জনের এবং মৃত্যুর সংখ্যা আগের দিনের মতো ৭ জন। এই তিনদিনের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের নিজেদের নিরাপদ ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বিশেষত সংক্রমণ অনুপাতে মৃত্যুর হার খুব বেশি। অপরদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৩ নভেম্বর করোনা শনাক্ত হয়েছে ৯১৯ জনের দেহে। যা ছিল আমাদের দেশের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি। এর আগের সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ৯১০ জন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। এই অবস্থায় শীতকে সামনে রেখে এবং প্রতিবেশি দেশের কথা বিবেচনায় এনে গত ২৬ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক থেকে করোনা প্রতিরোধে সাতটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনাগুলো যাতে যথাযথভাবে মানা হয় সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সতর্ক ও সচেতনতার ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে। নির্দেশনাগুলো নতুন কিছু নয়। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছেঃ সর্বস্তরে স্বাস্থ্যবিধি পালন ও মাস্ক ব্যবহার, জনসমাগম হয় এমন স্থানে যতটা সম্ভব ভিড় পরিহার, টিকা গ্রহণে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, বয়স্কদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়া, স্বাস্থ্যবিধি পালনে প্রচারের ব্যবস্থা করা, সমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠান পরিহারে উদ্বুদ্ধ করা এবং করোনা প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা।
আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত নিজের জীবনের চেয়ে অমূল্য সম্পদ আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই আমাদের সকলের প্রধানতম দায়িত্ব নিজের প্রতি যত্নবান হওয়া। চাচা আপন প্রাণ বাঁচাতে প্রত্যেককে নিজের ও নিজের পরিবারের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনার আমার একটুখানি অবহেলায় ঝরে পড়তে পারে নিজের কিংবা প্রিয়জনের জীবন। আর তাই স্বাস্থ্যবিধি পালনে ন্যুনতম ছাড় দেয়া যাবে না। সরকার কিংবা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আমাদের সতর্ক ও সচেতন করতে পারেন। কিন্তু বাঁচার জন্যে তথা করোনা প্রতিরোধে যা যা করণীয় তা নিজেদেরই করতে হবে। পাশাপাশি আমরা আশা করব স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারি হিসেবে নিজেদের মনে না করে মানবতার সৈনিক হিসেবে নিজেদের ওপর অর্পিত স্ব স্ব দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সহৃদয়তার সঙ্গে পালন করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্যসেবার মতো মহান সেবা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। একজন অসুস্থ মানুষ যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তখন তাঁর মুখে যে স্বর্গীয় হাসি ফুটে ওঠে তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ও ছওয়াব দুটোই একজন চিকিৎসাসেবীর প্রাপ্য।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক