করোনাকালীন দারিদ্র্য, শিক্ষাসঙ্কট ও বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে

12

 

বিগত আঠারো মাসের অধিক সময়কাল ভারতে উদ্ভূত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের পরিবর্তিত প্রকরণ করোনা সংক্রমণ-বিস্তার ও প্রাণনিধনের প্রবল তান্ডব বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রকে করেছে প্রচন্ড বিপর্যস্ত। একদিকে ভ্যাকসিন আবিষ্কার-উৎপাদন-বিতরণ বাণিজ্যের কদর্য রাজনীতি এবং অন্যদিকে বিশেষ করে অনুন্নত-উন্নয়নশীল বিশ্ব অনাকাক্সিক্ষত ভ্যাকসিন সঙ্কট ও জীবন-জীবিকার চালচিত্রে এখনও অসহনীয় পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। করোনার দুর্দÐপ্রতাবে কল্পনাতীত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে শিক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের সবগুলো খাত। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ গণমাধ্যম সূত্রে চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর জরিপে জানা যায়, করোনার পূর্বে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। জরিপের ফলাফলে প্রতিফলিত দরিদ্র্যতার মুখোমুখী ৫৬ শতাংশ পরিবারের দাবি, করোনার সময় তাদের আয় কমে যাওয়ায় তারা ধার করে, সঞ্চয় ভেঙ্গে ও খাদ্য ব্যয় কমিয়ে এই সঙ্কট উত্তরণ করেছে। এসব পরিবারের অনেক সন্তান শিক্ষা বাদ দিয়ে শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে দেড় বছর বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও; দীর্ঘসময় স্কুল বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরিবারের দারিদ্র্যের ব্যর্থ পরিহাসে ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্মে জড়িত হয়েছে। অনেক কোমলমতি মেয়েকে তাদের পরিবার কর্তৃক জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে সম্পন্নে বাধ্য করা হয়েছে।
আমরা সম্যক অবগত আছি যে, দেশে প্রতিবছর প্রাথমিক স্তর শেষ হওয়ার পূর্বে প্রায় ১৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তি এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু করোনায় উদ্ভুত পরিস্থিতে এসব পরিবার এবং আরও নতুন নতুন পরিবার দরিদ্র্য হওয়ার ফলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশের মতে ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে যোগ দিবে। পক্ষান্তরে মাধ্যমিকের ৪১.২ শতাংশ শিক্ষকের মতে বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি ৩৩.৩০ শতাংশের ধারণা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে এবং ২০ শতাংশ কর্মকর্তার অনেকেই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে যুক্ত হবে বলে মতামত প্রদান করেন। উল্লেখ্য সূত্রমতে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রতিবেদন বিশ্লেষণে উঠে আসে যে, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্য বইয়ের চাহিদা কমেছে ৭৭ লাখেরও বেশি। সাধারণত প্রতিবছর শিক্ষার্থী বাড়ার কারণে বছরে গড়ে প্রায় আড়াই শতাংশ পাঠ্য বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতে এবার শিক্ষার্থী বাড়ার এমন কোন তথ্য কোথাও নেই।
বিশ্বব্যাপী সুদীর্ঘকাল থেকে বাল্যবিবাহ একটি প্রচলিত প্রথা। বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশে বিয়ের সর্বনি¤œ বয়স বৃদ্ধিতে কালান্তরে এ প্রথা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সমাজে মেয়েদের সাধারণত বয়:সন্ধির আগেই বিয়ে দেয়া হত। প্রাচীন গ্রীসে কম বয়সে বিয়ে এবং মাতৃত্ব উৎসাহিত করা হত। সেখানে বাল্যবিবাহ ও কৈশোরে গর্ভধারণ অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল। প্রাচীন রোমে মেয়েদের বিয়ের বয়স ছিল ১২ এবং ছেলেদের ১৪ বছরের উপরে। মধ্যযুগে ইংলিশ আইন অনুসারে ১৬ বছরের পূর্বে বিয়ে সর্বজনস্বীকৃত ছিল। ১৫৩৩ সালে স্যাক্সিনি রাজ্যের রাজকন্যা এমিলিয়া মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রাচীন রোমান সা¤্রাজ্যের রাজপুত্র ৪৮ বছর বয়সী জর্জকে বিয়ে করেছিলেন। যদিও বিশ্বের সিংহভাগ দেশে বিবাহের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর ধরা হয়, অনেক দেশের আইনে অভিভাবক বা বিচারপতির সম্মতিক্রমে এর ব্যতিক্রম করা যায়। ১৯৮৩ সালের যাজকীয় আইন আনুযায়ী বিবাহের সর্বনি¤œ বয়স ছেলেদের ১৬ ও মেয়েদের ১৪ বছর ধার্য করা হয়। ২০১৫ সালে স্পেনে বিবাহের পূর্বাকার বয়স ১৪ থেকে ১৬ তে উত্তীর্ণ করা হয়। মেক্সিকোতে ১৮ বছরের নিচে অভিভাবকের সম্মতিতে বিবাহ দেয়া যায়, কিন্তু ছেলে ও মেয়ের ন্যূনতম বয়স যথাক্রমে ১৪ ও ১৬ বছর হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাজ্যে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে বাল্যবিবাহের অনুমতি দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যের কয়েকটি রাজ্যে ১৬-১৭ বছর বয়সী ছেলে মেয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিয়ের অনুমতি আছে। কিন্তু ১৬ বছরের নিচে হলে তা ১৯৭৩ সালের বৈবাহিক আইন অনুযায়ী তা বাতিল হয়ে যাবে।
ইউএনএফপিএ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০-২০১১ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশসমূহে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তাদের ১৮তম জন্মদিনের পূর্বেই বিবাহিত। ২০১০ সালে এর আনুমানিক সংখ্যা প্রায় ৬৭ মিলিয়ন এবং ১২ শতাংশ নারী ১৫ বছরের আগে বিবাহিত। স্থানভেদে বাল্যবিবাহের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সমগ্রবিশ্বে শহরাঞ্চলের মেয়েদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের বাল্যবিবাহের প্রবণতা প্রায় দ্বিগুন। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকার তিন দেশে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৭০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে নাইজারে বাল্যবিবাহের হার সর্বোচ্চ। ২০-২৪ বছর বয়সী নাইজেরীয়ান নারীদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ নারী ১৮ বছরের আগে এবং ২৮ শতাংশ নারী ১৫ বছরের আগে বিয়ে করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালে অর্ধেকেরও বেশি বাল্যবিবাহ সংগঠিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আফগানিস্তান ও তুরস্কে ১৮ বছরের আগে বিবাহিত নারীর হার যথাক্রমে ৫৩ শতাংশ ও ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। ইয়েমেনে বিয়ের বয়স ১৫ বা ১৮ করার প্রচেষ্টাকে ইয়েমেন সরকারের শরীয়াহ আইন বিভাগ একে ইসলাম-বিরোধী ঘোষণা দিয়ে বাধাগ্রস্ত করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বেশি। বার্মিজ কারেন উপজাতিরা বাচ্চার জন্মের পূর্বে তাদের বিয়ে ঠিক করে রাখে। ইন্দোনেশিয়াতে মুসলিম আলেমগণ একাধিক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বিয়ে করে থাকেন, যাদের অনেকের বয়স ১২ বছরেরও কম।
বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হারের দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে সময়ের ২৫-২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের আগে। “বিশ্বজুড়ে শিশুদের অবস্থা-২০০৯” এর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৬৩ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। বাংলাদেশে মেয়েদের বিবাহের সর্বনি¤œ ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছর হলেও ২০১৭ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধক বিল পাশের মাধ্যমে ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতিতে ১৮ বছরের নিচে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়। এপ্রিল ০২, ২০২১ প্রকাশিত বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট ৬৪ টি জেলার মধ্যে ২১ টি জেলার ৮৪ টি উপজেলায় বাল্য বিবাহের মাত্রা নিয়ে পরিচালিত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, যে সকল শিশুরা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তাদের ৫০ দশমিক ৬ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর, ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর এবং ১ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। উক্ত সময়ে উল্লেখ্য জেলাগুলোতে অন্তত ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটেছে বলে সংস্থাটি প্রকাশ করেছে।
দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন বিবাহ বিচ্ছেদ ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রে একটি সুদূরপ্রসারী ভয়ঙ্কর সমস্যা। সাধারণত দীর্ঘকাল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অসদ্ভাব বা মনোমানিল্যের পরিসমাপ্তি ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। ক্ষেত্রবিশেষে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের তিক্ততার অতিমাত্রায়ও বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। তবে সামাজিক কাঠামো ও জীবনধারাগত বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকলে সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় এবং এর হার বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। যেমন ধর্মীয় অনুশীলনে বিধি-নিষেধ কম হলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার উর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আইনগত বাধা কম হলেও বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। শিল্পায়নের ফলে পরিবারের লোকজনের উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণে পরস্পরের নির্ভরশীলতা হ্রাস এবং মহিলাদের কর্মসংস্থান প্রসারিত ও পুরুষদের উপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে যাওয়া, ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সেবামূলক কাজকর্ম সম্পাদিত হওয়ায় রান্নাবান্না-পোশাক পরিচ্ছদ তৈরি-কাপড় কাচা-বিনোদন প্রভৃতি সেবা-সহযোগিতামূলক কাজে নারী ও পুরুষ উভয়ের নির্ভরশীলতা হ্রাস বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য। উল্লেখিত কারণ ছাড়াও বাল্যবিবাহ বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
দেশের বরেণ্য সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী করোনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি সামাজিক-মানসিক চাপের ফলে উদ্ভুত পারিবারিক কলহ এবং করোনাকালে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল, পারস্পরিক বোঝাপড়া না হওয়াকেও তাঁরা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য দায়ী করছেন। ২৬ জুন ২০২১ গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, শুধু ঢাকাতেই দিনে ৩৮ টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রতিমাসে ৯৯ টি বিচ্ছেদ বেড়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের তথ্যানুযায়ী, ৭৫ শতাংশ ডিভোর্সই দিচ্ছে নারীরা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৪ হাজার ৫৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে অর্থাৎ মাসে ১ হাজার ১৪১টি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজর ৪২টি। বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে পুরুষেরা মূলত তাদের প্রতি স্ত্রীর সন্দেহপ্রবণতা, সংসারের প্রতি স্ত্রীর উদাসীনতা, বদমেজাজ, সন্তান না হওয়া এবং নারীর পরকীয়া প্রেম, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তি ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশে এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
২৩ জুলাই ২০২১ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস-২০২০’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে গত পাঁচ বছরে পুরুষের তুলনায় নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে। এর মধ্যে অনেক নারী তাদের স্বামী কর্তৃক তালাকের শিকার হয়েছেন আর অনেকে নিজে থেকে বিচ্ছেদ নিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে নারীদের ক্ষেত্রে তালাক ও বিয়ে বিচ্ছেদের হার বেড়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ হার ছিল যথাক্রমে ১০, ১০.৫, ১০.৮, ১১ ও ১১.৩ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের ক্ষেত্রে প্রথমবিয়ের গড় বয়স কিছুটা নিম্নমুখী। ২০১৬ সালে পুরুষের বিয়ের গড় বয়স ছিল ১৮ দশমিক ৪ বছর এবং ২০২০ সালে তা কমে হয়েছিল ২৪ দশমিক ২ বছর। নারীর ক্ষেত্রে উক্ত সালসমূহে বিয়ের গড় বয়স ছিল যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৪ ও ১৮ দশমিক ৭ বছর। প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বিবাহিত পুরুষের হার ছিল শতকরা ৬০, অবিবাহিত পুরুষ ৩৮ দশমিক ৩ ও তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে এমন পুরুষ ১ দশমিক ৭ ভাগ বিরীতে বিবাহিত নারী ৬৩ দশমিক ২, অবিবাহিত নারী ২৫ দশমিক ৫ ও তালাক বা বিচ্ছেদ প্রাপ্ত নারী ১১ দশমিক ৩ ভাগ। পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি তালাকপ্রাপ্ত ও বিচ্ছিন্ন আবস্থায় থাকছেন।
উল্লেখ্য সূত্রমতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে। মহামারীকালে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে বিবিএস’র আশঙ্কা। সংস্থার ২০২০ সালের প্রতিবেদনে জানা যায়, মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রতি হাজারে ১০.৮ শতাংশ নারী এবং ১.৫ শতাংশ পুরুষ বিবাহ বিচ্ছেদ করেছে। বিচ্ছেদ আবেদনকারীর মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পাস এবং অশিক্ষিতদের এই হার (প্রতি হাজারে) যথাক্রমে ১.৭ ও ০.৫। আবেদনের হার গ্রামে প্রতি হাজারে ১.৩ এর বিপরীতে শহরের হার ০.৮। বয়সের দিক থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনকারী ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরাই বেশি। বিবিএস’র গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার তুলনায় বিভাগীয় অঞ্চল ও জেলাশহরগুলোতে নারী-পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদের হার-আশঙ্কা উভয়ই বেশি। গ্রামের দম্পতিরা শহরের দম্পতিদের তুলনায় বিবাহ বিচ্ছেদে বেশি আগ্রহী। বিভাগীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ এবং তুলনামূলক কম আছে চট্টগ্রাম ও সিলেটে। গবেষণায় আরও জানা যায়, ২৭-৩০ বছরের মধ্যে বিবাহকারীদের দাম্পত্য জীবন টেকসই ও স্থায়ী হয়। অন্যদিকে টিনএজ (১৩-১৯) বা ৩২ বছরের অধিক বয়সে বিবাহকারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যারা কম বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় বা বাল্যবিবাহ করে।
উল্লেখিত প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, বাল্যবিবাহ ও সংশ্লিষ্ট বিবাহবিচ্ছেদ দ্রুততর সময়ের মধ্যে প্রতিরোধ করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ-পারিবারিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধকরণ-মনস্তাত্তি¡ক সমস্যা নিরসনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা-পরামর্শ সেল স্থাপন এবং সর্বোপরি সমাজের সকল সচেতন জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে প্রণীত পরিকল্পিত কর্মকৌশল বাস্তবায়নের সঠিকপন্থা অবলম্বনে সময়ক্ষেপনের কোনো অবকাশ থাকার পক্ষে মতামত পোষণ করি না। অনতিবিলম্বে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধানকল্পে প্রায়োগিক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে নিগূঢ় দুরাশার দৃশ্যাদৃশ্য জাতিকে করুণ আর্তনাদে বিষাদগ্রস্ত করবেই – নিঃসন্দেহে তা বলা যায়।

লেখক: শিক্ষাবিদ- সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়