কম খাওয়ার অসুখ অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা

14

হাসিনা আকতার লিপি

মেয়েদের মধ্যে এই অসুখ বেশি দেখা যায়। এই রোগটা হচ্ছে এমন যে রোগীণীর খাওয়ার ইচ্ছা অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। অনেক সময় এর আরম্ভ হয় অল্পবয়স্ক মেয়েদের স্লিম হবার ইচ্ছা থেকে। ধীরে ধীরে খাবার ইচ্ছেটাই চলে যায় এবং রোগীর ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। এই না খাওয়ার ইচ্ছা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে জোর করে নাকে নল দিয়ে খাওয়াতে হয়। এই না খাওয়া এবং ওজন কমে যাবার জন্য রোগী কোনোরকম অসুবিধা বোধ করেন না এবং তাঁর স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যান।
তাঁরা মানসিকভাবেও সুস্থ থাকেন। রোগ শুরু হয় কম বয়সেই। বলা যায় টিন এজারদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি। এই রোগে আক্রান্তদের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। সাধারণভাবে সমস্যাই মনে হয় যে খেতে চায় না বা কম খায়।
স্বভাবতঃই যারা কম খায়।
কম সবসময়ই কম অর্থাৎ বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) ১৮.৫ এর নীচে থাকে।
ওজন বাড়বে এটা নিয়ে যারা সবসময়ই ভয়ে আতংকে থাকে। তাদের খাওয়ার আগ্রহ কমে যায়।
খাবার খেতে বললেই তারা সবসময় ‘না’ বলবে সেজন্য তাদের ওজনও কম থাকে।
অল্প পরিমাণ এবং নির্দিষ্ট খাবারই খায় তাদেরও কম ওজনের হয়ে থাকে।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যায়াম করে, অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে।
এতে মেয়েদের যে জটিলতা তৈরি হতে পারে অষ্টিওপেরোসিস, ইনফার্টিলিটি এবং হার্ট ড্যামেজ এবং অন্যান্য এমনকি সময়ের আগে মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে, রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। অনেক সময় দেখা গেছে বয়ঃসন্ধির সময় কেউ কেউ দেহের গঠনের স্বাভাবিক পরিণতি মেনে নিতে পারেন না। তারা বড় হতে চান না, চেহারা বালিকাসুলভ রাখতে চান, ছোট থাকতে চান তাই তাঁরা খাওয়া কমিয়ে ছোট হতে চেষ্টা করেন। আবার অনেক সময় হৃষ্টপুষ্ট চেহারার কোনও শিশুকে তার বন্ধুরা মোটা বলে ক্ষেপায়। সে বেচারি মোটা অপবাদে বিরক্ত হয়ে রোগা হবার জন্য খাওয়া বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে অনেকে কিটো ডায়েট নামরে এক ধরনের ডায়েট মানছে যা কিশোর কিশোরীদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
পারিবারিক অশান্তি অনেক সময় এই রোগের কারণ হয়। বাবা-মার মধ্যে অশান্তি কিশোরী মেয়ের মনের উপর প্রভাব ফেলে এবং তাদের এই রোগের শিকার করে।
রোগের লক্ষণ ঃ কিশোরীরাই প্রধানত এই রোগের শিকার হন। স্বাভাবিক ওজনের ২৫% কমে গেলে ডাক্তার অ্যানরেক্সিয়া নার্ভোসা হয়েছে মনে করা হয়। খাবারে অস্বাভাবিক অনীহা ছাড়া শরীরে আর কোন অসুবিধা থাকে না। অন্যান্য কাজ স্বাভাবিক ভাবেই করতে পারেন। অনেক সময় নিজেকে রোগা নয়, মোটাই মনে করেন। নিজেকে স্বাভাবিক দেখাবার জন্য টাইট পোশাক না পড়ে ঢিলেঢালা পোশাক পরেন। ওজন নেবার সময় কম ওজন গোপন করবার জন্য পোশাকের আড়ালে কোনও ভারী জিনিস লুকিয়ে রাখেন। ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। নিজে না খেলেও অন্যকে পরিবেশন করে খাওয়াতে ভালবাসেন এবং তাঁদের খেতে দেখে নিজে তৃপ্ত হন। হার্ট রেট ও রক্তচাপ কমে যায়। অ্যানিমিয়া। খসখসে চামড়া।
জটিলতা: এই অসুখটিকে কখনই হাল্কাভাবে দেখা উচিত নয়। ক্রমাাগত কম খাওয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আগেই বলা হয়েছে ইমিউনগেøাবিন কমে যায়, ফলে এঁরা নানা অসুখের শিকার হন। ভেন্টিকুলার ফিব্রিলেশন হয়ে হঠাৎ মৃত্যু হতে পারে। এই অসুখকে কেবল মনের রোগ বলে ফেলে রাখার উচিত নয়। হাড় দুর্বল হয়ে যায়। চুল পড়ে যায়
চিকিৎসা: কোনও নির্দিষ্ট ওষুধের সাহায্যে এই রোগের নিরাময় করা সম্ভব হয় না। চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হল আস্তে আস্তে রোগিণীর ওজন বাড়ানো। মোটামুটিভাবে প্রতি সপ্তাহে অন্ততঃ এক কেজি ওজন বাড়াবার চেষ্টা করা হয়। এটি অবশ্য খুব সহজ কাজ নয়। এতে সফল হতে হলে প্রথমেই চিকিৎসককে রোগিণীর আস্থা অর্জন করতে হবে। তাঁকে সময় নিয়ে কম খাওয়ার বিপনের বিষয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে এবং উচ্চ ক্যালরীযুক্ত মুখরোচক খাবার পরিমাণে কম কিন্তু বারে বারে খাওয়ার অভ্যাস শুরু করতে হবে।
সাইকোথেরাপিÑমানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হতে পারে। নাছোড়বান্দা রোগিণী বা শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হলে, রোগিণীকে জোর করে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে নল দিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সারাদিনের খাবারকে ৬-৭ বার ভাগ করে দিতে হবে। তবেই লক্ষ্য অনুযায়ী ওজন কত কেজি বাড়াতে হবে ঐভাবে একটি চার্ট করে নিয়মিত ধৈর্য্য সহকারে মানতে হবে।

লেখক: ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট