কবি ময়ুখ চৌধুরীর একগুচ্ছ শব্দ-পারিজাত

84

শীর্ষস্থান

আপাতত শীর্ষে তুমি
মেঘের আড়াল থেকে এক হাতে ছুঁয়ে আছ চাঁদের পাথর,
মনোরম আমাবস্যা তাই।
তবু তুমি দৃশ্যময়ী নান্দনিক দেবী,
আপাতত শীর্ষস্থানে তুমি। তার নিচে
সবুজ বন্ধনীযুক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী চুম্বক পাহাড়।
প্রতিটি ভাঁজের মধ্যে প্রতিটি খাঁজের মধ্যে জাহাজের ক্ষুধার্ত নোঙর।
তারপর ঝরনার সাবলীল হাসির গমক
আনন্দিত নুড়ি ও পাথর।
তারপর উপচে ওঠা সোনালি বালির গল্প আপাতত থাক।

এইসব অভিরাম অত্যাচার আর
তার নিচে চাপা পড়ে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি আমি
ভূ-গর্ভের অন্ধ বিস্ফোরণে।

হাজার বছর পরে কার্বনের অন্ধকার থেকে
হীরাজন্ম নিয়ে যদি উঠে আসতে পারি
এখন যেখানে আছ সেইখানে থাকবে তো তুমি?

অন্তত একবার

দেয়ালের পলেস্তরা খসে
সুন্দরী পাতার গন্ধে মৃত হরিণের ছাল পুনর্জন্ম নেয়,
মৃগনাভি গন্ধ তবু তোমাকে ফেরাতে পারলো না।

তোমাদের বাড়ির পাশেই বাঁকা নদী,
মৃতমাছ চোখ মেলে তোমাকে খুঁজেছে কতোবার,
তবু তুমি হাত ভেজালে না।
প্রতিটি ৯-এর পরে ঘুরে ঘুরে আসে গোল চাকা,

তোমার পায়ের পাতা-চেয়ে দ্যাখো
সেইখানে চ্যাঁকা আছে প্রাচীন ইথাকা।

নদীরাও ফিরে আসে জোয়ারের নামে। তুমি
অন্তত একবার ফিরে এসো,
শেষবার দেখাদেখি হোক।
তারপর ফিরে যাও, আকাশের শূন্যতা সাজাও।

চিকিৎসাবিজ্ঞান

প্রতিদিন অসুখের সঙ্গে দেখা হয়,
এরপরও বুঝি নিশ্চয়
সুখের নদীতে ঢেউ, ভাসমান তোমার সাম্পান।

অথচ আমাকে চেয়ে দ্যাখো,
আমাকে পাহারা দেয় চারিদিকে সুন্দর পাহাড়,
তবুও আমার চোখে শরণার্থী তাঁবু ভেসে ওঠে।
বাগানের ফুলগুলি সবুজ পাতার ফ্রক পরে
হাতছানি দিয়ে ডাকে, তবু আমি নিথর পাথর।
কতো পাখি কাছে আসে, আমাকে উড়িয়ে নিতে চায়,
তখন বৃক্ষের মতো দুই পায়ে শিকড় গজায়।

চারিদিকে চাপা কান্না হওয়ার ডানায় ভেসে আসে,
সব নদী সব গান তোমাকেই যেন ভালোবাসে।

এখানে বৃষ্টি, বর্ষা ওখানে

এখানে বৃষ্টি হচ্ছে, রাজপথে ছোট ছোট নদী
জলবন্দী থমকে আছি ঢাকার রাস্তায়
আমার পায়ের কাছে সাতবার ঘুরপাক খায়
বিগলিত বৃষ্টির বিড়াল।
সেও কি আমার সঙ্গে পরীবাগে উড়ে যেতে চায়!
কী করে আমার সঙ্গে তাকে নিয়ে যাই!
জলবন্দী পড়ে আছি ঢাকার রাস্তায়;
বর্ষা পড়ে আছে চিটাগাঙে।
হয়তো পড়ার ঘরে কিংবা একা ছাদে
মাথার ওপরে তার মনখারাপের মতো মেঘ
বৃক্ষের সবুজ খোঁপা উদাস পিপাসা নিয়ে স্থির।
আকাশের বৃষ্টি নামে মৃত্তিকার বুকে।
এ দৃশ্য দেখেও বর্ষা
পৃথিবীটা স্ত্রী-লিঙ্গ কেন-
এই প্রশ্ন জানা নেই তার।
যদিও অনেকবার ঘুরে ফিরে বোঝানো হয়েছে-
আকাশের ভালোবাসা ধরণীরে ঘরনি করেছে।

হে ধর্ম, হে রাজনীতি

আকাশের নীল তাঁবু ফেটে যাচ্ছে লাল আর্তনাদে
শিশুর কান্নার জলে শিউরে ওঠে নীল তোলপাড়।
হে ধর্ম, হে রাজনীতি, আর কতো রক্ত পান করা!
অস্তিত্বের কূটতর্কে ধসে যাচ্ছে বিষন্ন পাহাড়।

বিশ্বমানচিত্র জুড়ে অনায়াসলভ্য কেন লাশ
প্রেমের সম্পর্কে কেন সুতানালী সাপের বিন্যাস?

সভ্যতার নামে আজ দিকে দিকে বারুদের খেলা
তার বিপরীতে দ্যাখো, উজানের মমতার ভেলা।

ট্যাপেটাম লুসিডাম

সবশেষে মোমবাতির শিখাটিও এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিয়েছি।
তারপর পিপাসার্ত ভারী অন্ধকারে
বিড়ালের চোখ পরে বসে আছি।

সহস্র আলোকবর্ষ দূর থেকে দেখা
ঘুমাভাঙা নক্ষত্রের স্বপ্ন থেকে উড়ে আসছে আলো।
সকলের আগে এই ভার্জিন আলোর ছোঁয়া পাবো বলে
যথাযথ তৃষ্ণা মেখে বিড়ালের চোখ পরে বসে আছি।

অভ্যস্ত মলিন স্বপ্নে আর কোনো অভিরুচি নেই
সমস্ত পার্থিব স্বপ্ন আমাকে করেছে প্রতারণা;
যতই লোভাক-না কেন উর্বশীর ঊর্মিল বৈভব
সব মোহ পুঁতে ফেলে অন্ধকারে বসে থাকবো একা।

বড় দুঃখে আমি আজ স্বপ্নবিদ্ধ প্রাণী,
আমাকে মানুষ বলে ডেকো না তোমরা;
অন্ধকারে সর্বশেষ বিশ্বাস ধরেছি এই চোখে।