কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কেনো এখনো প্রাসঙ্গিক?

12

ড. মো. মোরশেদুল আলম

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে প্রবন্ধটি শুরু করতে চাই। তিনি লিখেছেন, “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,/ লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর/ হে নগরসভ্যতা হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,/দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,/ গøানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,/ সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,/ নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,/ মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন/ মহাতত্ত¡গুলি পাষাণপিঞ্জরে তব/ নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব/ চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,/ বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,/ পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন/ অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।” বুদ্ধদেব বসু বলেেেছন, যত দিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে, রবীন্দ্রনাথ পঠিত হবেন ততদিন, তাঁর প্রাসঙ্গিকতাও থাকবেÑ মাত্রার তারতম্যভেদে। পরাধীন ভারতের স্বাধিকার অর্জনের আকাক্সক্ষায় সমকালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভীষণ অগ্রগামী। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে, বাঙালির রাজনৈতিক অর্থনীতির আঙিনায় তিনি এখনো প্রাসঙ্গিক। শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় তিনি প্রেরণার উৎসমূল। তিনি সৃষ্টিশীল নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করেছেন। কারণ আমরা জানি, উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ছিল একটি অবিকশিত প্রাদেশিক ভাষামাত্র। ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষার মতোই বাংলা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছিল ভবিষ্যতের দিশা। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একদিকে চলছে ঔপনিবেশিক পÐিত ও কর্মকর্তাদের অনুশীলন, অন্যদিকে চলছে সংস্কৃতসেবীদের শুদ্ধি অভিযান। তার ওপর সবকিছু টপকে গিয়ে চূড়ায় বসে আছে নব্য বাঙালির ইংরেজিয়ানা। ভাষাগত এই পটভূমির ওপর গড়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে পূর্ববঙ্গে এসে ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি এখানকার জনগণকে উক্ত ভাষণগুলোর মাধ্যমে দর্শন দিয়েছেন। বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এমনকি মুক্তিসংগ্রাম অথবা পাকিস্তানি সামরিক-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দুঃশাসন থেকে কবিগুরু ও আমাদের সংস্কৃতির সংগ্রামী চেতনার পত্তন হয়েছিল।
রবীন্দ্রভাবনায় বাঙালির আত্মশক্তির বিকাশ, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা লাভের উপায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমবায়, কৃষিব্যবস্থাপনায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয় বারবার উঠে এসেছে। পূর্ববঙ্গে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের ভাষণে কোনোটিতে শিক্ষার সমস্যা আলোচিত, কোনোটিতে জীবনের আদর্শ বা ধর্ম, আত্মিক সমস্যা বা দর্শনও ধারণ করেছে। বাদ যায়নি রাজনীতি এবং তার আদর্শ কী হওয়া উচিত সে কথাও উঠে এসেছে। নারায়ণগঞ্জে প্রদত্ত ভাষণে বিশ^কবি বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জের প্রবেশদ্বার দিয়ে আমি পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করেছিলাম। ফেরার পথে আবার এখানে এসেছি। পূর্ববঙ্গের যেখানে গিয়েছি, আমার বলবার কথা বলেছি; কিন্তু বলার দ্বারা ফল হয় বলে আমি বিশ^াস করিনে। কর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশের বিচিত্র সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যালয়ে চাকুরিই ছিল শিক্ষার উদ্দেশ্য। সৌভাগ্যক্রমে চাকুরির পথ সংকীর্ণ হয়েছে। তাই শিক্ষিত যুবকগণ স্বাধীন উপায়ে জীবিকা অর্জনে সচেষ্ট হয়েছে। শিক্ষাকে এখনো চাকুরির পন্থা বলে গণ্য করা হয়, তবে সে মোহ ক্রমে ক্রমে কমে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের সেই কবে বলা কথাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক। নাট্যকর্মী আলী যাকের রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে ১৯৭৫ সালের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পেছনে বাঙালিদের যে চেতনা, মূল্যবোধ ও আদর্শ ছিল, তার বিরোধিতা বেড়ে চলছিল, তা বন্ধ করার উদ্যোগ চলছিল। বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে রড় এক হাতিয়ার ছিলেন। গত শতাব্দীর আশির দশকে রবীন্দ্রনাথকে আবারো আঁকড়ে ধরতে হয়েছিল সে সময়কার সংকট কাটাতে। পরবর্তী সময়ে যদিও পরিস্থিতি অনেক শুধরেছে, সংস্কৃতিকর্মীদের পথ অনেকটাই সুগম হয়েছে, তবুও রবীন্দ্রনাথ থেকে গিয়েছেন, তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করা, রবীন্দ্রনাথের মুক্ত চেতনাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার ঝোঁকে। আর আজও রবীন্দ্রনাথের দেশজ প্রয়োজন, রাজনৈতিক প্রয়োজন, সমসাময়িক প্রয়োজন আছে। তবে তার চেয়েও বেশি যেটা প্রয়োজন, সেটি হলো রবীন্দ্রনাথকে আরও ভালো করে জানা, তাঁকে অন্তরে ঠাঁই দেওয়া, রবীন্দ্র দর্শনে নিজেদের উজ্জীবিত করা। বিশ^কবি যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার কলমকে হাতিয়ার করে মানুষকে জাগরণের বাণী শুনিয়েছেন, দেশমাতৃকাকে ভালোবাসার উদাত্ত আহŸান জানিয়েছেন। স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ করেছেন দেশবাসীকে প্রবল মনোবল নিয়ে দুরন্ত প্রতাপে এগিয়ে চলার জন্য। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছেন তাঁর বাণীতে, লেখায়, গ্রন্থে-গানে, কবিতায়, গল্প-উপন্যাস, নাটকে, নৃত্যনাটকে। হত্যার প্রতিবাদে ব্রিটিশের পুরস্কার প্রত্যাহার করতে তিনি দ্বিধা করেননি। তেমনি সমাজকেও সাজাতে চেয়েছিলেন সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায়। ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।/ নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,/ ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।’
শিল্পবিপ্লবের ব্যাপক বিস্তারে গড়ে ওঠা নগর জীবনের যান্ত্রিকতার বহরে পল্লী তার সব শ্রী হারাতে বসেছে, এটা দেখে কবি বিচলিত হয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, কেবল এক শ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলে বা শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন হলে সমগ্র দেশের সম উন্নয়ন হয় না। প্রয়োজন দেশের সামগ্রিক উন্নতির। পল্লীবাসীরা অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকলে দেশের যথাযথ উন্নতি হয়েছে বলে তিনি মানতেন না। আজকের পৃথিবীতে করোনা মহামারীর কালে সেসব পরিবর্তন আরও বহুমুখী ধারায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নাগর নদীর ঘাট কালিগ্রাম থেকে ১৮৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর লেখা ‘ছিন্নপত্র’-এর শেষ চিঠির মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করি এই ভূখÐের প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অন্ত ছিল না। তিনি মানুষের সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবেছেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পটূমিতে, রাষ্ট্রব্যবস্থার পটভূমিতে এবং সেই সাথে শাস্ত্রেরও পটভূমিতে। ১৮৯৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দীঘাপতিয়ার জলপথে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ দেখেন প্রবল বন্যায় দেশ ভেসে গেছে। তখন তিনি লিখেছিলেন, ‘গৃহস্থের মেয়েরা ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাদলার ঠাÐা হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে জল ঠেলে ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মতো ঘরকন্যার নিত্যকর্ম করে যায়, তখন সে দৃশ্য কোনোমতেই ভালো লাগে না। ঘরে ঘরে বাত ধরেছে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ¦রে ধরেছে, পিলেওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না। এত অবহেলা অস্বাস্থ্য অসৌন্দর্য দারিদ্র্য মানুষের বাসস্থানে কি এক মুহূর্ত সহ্য করা হয়! সকল রকম শক্তির কাছে আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। প্রকৃতি উপদ্রব করে তাও সয়ে থাকি, রাজা উপদ্রব করে তাও সই, শাস্ত্র চিরদিন ধরে যে সকল উপদ্রব কবে আসছে তার বিরুদ্ধেও কথাটি বলতে সাহস হয় না।” রবীন্দ্রনাথের এই লেখা এবং তাঁর চিত্রিত দুরবস্থার উপস্থিতি এই করোনা মহামারী কালেও ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন স্কুলকে বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেছিলেন। শ্রীনিকেতনে গড়ে তুলেছিলেন কুটির শিল্প ও সমবায় প্রতিষ্ঠান। একইভাবে পূর্ব বাংলার কৃষকদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির আধুনিকায়নের জন্য বিবিধ উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। পূর্ব বাংলায় তাঁর জমিদারিতে বিশেষ করে পতিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজারাই ছিলেন মুসলমান। তাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল আত্মিক। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। মেয়েদের শিক্ষার ওপরও তিনি জোর দিয়েছিলেন। কৃষির উন্নতির জন্য কৃষি গবেষণা ও সমবায় ব্যাংকও গড়ে তুলেছিলেন। অর্থ-বিত্ত-চিত্ত দিয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায় যেন উৎপাদন ও উন্নয়নমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ধনবৈষম্যকে কখনো প্রশ্রয় দেননি। তিনি চেয়েছিলেন সবার সহযোগিতায় সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন। তিনি সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায়কে আপন আপন গ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে না রাখার অনুরোধ করেন। সমবায় কাজে তাঁরাও যেন অংশগ্রহণ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখেন। শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসবে ১৯৩৪ সালে ‘উপেক্ষিত পল্লী’ শীর্ষক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “বর্তমান সভ্যতায় দেখি এক জায়গায় একদল মানুষ উৎপাদনের চেষ্টায় নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছে, আর এক জায়গায় আর একদল মানুষ স্বতন্ত্র থেকে সেই অন্নে প্রাণ ধারণ করে। চাঁদের যেমন এক পিঠে অন্ধকার, অন্য পিঠে আলো এ সেই রকম। একদিকে দৈন্য মানুষকে পঙ্গু করে রেখেছে, অন্যদিকে ধনের সন্ধান, ধন অভিযান, ভোগবিলাস সাধনের প্রয়াসে মানুষ উন্মক্ত। অন্নের উৎপাদন হয় পল্লীতে আর অর্থের সংগ্রহ চলে নগরে। অর্থ উপার্জনের সুযোগ ও উপকরণ যেখানেই কেন্দ্রীভূত, স্বভাব সেখানেই আরাম আরোগ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোককে ঐশ^র্যের আশ্রয় দান করে। পল্লীতে সেই ভোগের উচ্ছিষ্ট যা কিছু পৌঁছায়, তা যৎকিঞ্চিৎ। এই বিচ্ছেদের মধ্যে যে সভ্যতা বাসা বাঁধে তা বেশিদিন টিকতেই পারে না।” বর্তমান অনেক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে ও সমাজে এখনো দারিদ্র্য ও ধনবৈষম্য পরিলক্ষিত হয়।
কবিগুরু বরাবরই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। সম্প্রদায় নয়, সচেষ্ট সমাজের সক্রিয়তার ওপর বেশি আস্থা রেখেছিলেন। ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির তিনি ঘোরবিরোধী ছিলেন। হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশেই একটি সমন্বিত সমাজের উন্নতি তার আরাধ্য ছিল। ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মাঝখানে এমন একটি সংযোগস্থল সৃষ্টি হইতেছিল যেখানে উভয় সমাজের সীমারেখা মিলিয়া আসিতেছিল;….আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে নানা স্থানে ধর্ম ও আচার লইয়া যে সকল ভাঙ্গা গড়া চলিতেছে শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহার কোনো খবর রাখে না। যদি রাখিতেন তো দেখিতেন, এখনো ভিতরে ভিতরে এই সামঞ্জস্য সাধনের সজীব প্রক্রিয়া বন্ধ নাই।’ ব্যক্তির আত্মসচেতনতা, বিরাট ব্রহ্মাÐে নিজেকে শনাক্ত করতে পারার দীক্ষা মেলে রবীন্দ্রসাহিত্যে। আর রোমান্টিক এই আত্মসচেতনতা আধুনিকতারও উৎস। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অহমের আত্মকেন্দ্রিকতা একেবারেই অপছন্দ করতেন। তাঁর পরিবর্তে তিনি আত্মশক্তির কথা বলেছেন; যা সামষ্টিকতার অংশ।
বাঙালির জাতীয় চৈতন্য ও জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পেছনে রবীন্দ্রসাহিত্য ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। প্রতিরোধের চৈতন্য বোঝার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন দারুণ এক শক্তি। তাঁর বিস্তৃত জীবনজুড়ে আমরা খুঁজে পাই সক্রিয় সব কর্মযজ্ঞের ইতিহাস। তাঁর মধ্যে সমকালকে বোঝার তাগিদ ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। আপন দেশ ও বিশ^ পরিস্থিতিকে তিনি চমৎকারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সভ্যতার ধারণাটি আজ তাঁর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি লিখেছেন, ‘সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কী অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘নিভৃতে সাহিত্যের রস সম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন হতে একদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হলো, তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীর-মনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক, তার এমন নিরতিশয় অভাববোধ হয় পৃথিবীর আধুনিক শাসনচালিত কোনো দেশেই ঘটেনি। অথচ এই দেশ ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে তার ঐশ^র্য জুগিয়ে এসেছে। যখন সভ্যজগতের মহিমা ধ্যানে একান্ত মনে নিবিষ্ট ছিলেম, তখন কোনো দিন সভ্য নামধারী মানব আদর্শের এত বড়ো নিষ্ঠুর বিকৃতরূপ কল্পনা করতেই পারিনি; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভেতর দিয়ে বহু কোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্য জাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য।’ একই দেহে লীন সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের জাতিক ও আন্তর্জাতিক বিস্তার তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর তাঁর ভাবনার পরিসরে এসে গেছে সেকালের চীন, জাপান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, ইরান প্রভৃতি দেশের কথা। ইউরোপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সমস্ত ইউরোপে বর্বরতা কী রকম নখদস্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত দিয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথের এ সকল উক্তি ও উপলব্ধি বর্তমান সময়ের জন্যও প্রাসঙ্গিক।
ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বৈষ্ণব সাহিত্য ও উপনিষদ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে।’ আর সেই হাওয়াতেই রচিত হলো গীতবিতানের কতশত গান। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেলেন বিপুল সাহিত্যসম্ভার, বিকশিত বাংলা ভাষা, বহুবিধ সাংস্কৃতিক কৃত্য, জাতীয় চৈতন্য আর এক সর্বগ্রাহী মন। একজন দিগন্তবিহারী কবি মগ্ন হয়ে ভাবছেন প্রকৃতি-আশ্রিত শিক্ষা প্রসঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে নিচ্ছেন উৎসব ও আনন্দকে, সনাতন গ্রামÑকৃষি ও কৃষকের সম্পর্ককে দিতে চাইছেন নতুন এক বন্দোবস্ত, প্রকৃতি ও মানুষের চিরায়ত সম্বন্ধকে বুঝাতে চাইছেন দার্শনিক ও প্রায়োগিকভাবে। বর্তমান সময়েও তাঁর দর্শন ও ভাবনা তাই প্রাসঙ্গিক।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়