কন্টেইনার পাচারচক্রে বন্দরের নিরাপত্তারক্ষী ও আনসার সদস্য

15

নিজস্ব প্রতিবেদক

নথিপত্র দাখিল না করেই আমদানিকৃত প্রায় ২৫ মেট্রিক টন প্লাস্টিকের দানা ও ৩২ রোল ফেব্রিকসভর্তি কন্টেইনার জালিয়াতির মাধ্যমে বন্দর থেকে পাচারের চেষ্টার সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সংঘবদ্ধ ওই চক্রে বন্দরের পরিবহন ও নিরাপত্তা বিভাগের কয়েকজন কর্মচারী ও আনসার সদস্য এবং কন্টেইনার খালাস প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত অপারেটরও রয়েছেন। পুলিশের দাবি, মদভর্তি কন্টেইনার পাচারের ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বন্দরের নিরাপত্তারক্ষী মোজাম্মেল হোসেন রবিন এই চক্রের মূলহোতা। বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মার্চ সকালে বন্দরের সাউথ কন্টেইনার ইয়ার্ড (গুপ্তখাল) থেকে তিনটি ট্রেইলরে পণ্যবোঝাই দু’টি কন্টেইনার বের করে নিয়ে যাবার সময় নিরাপত্তা ফটকে আটকে দেয়া হয়। ফটকে দায়িত্বরত একজন গোয়েন্দা সদস্যকে মারধর করে একটি খালি ট্রেইলর চালিয়ে চালকের সহকারী পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাকি দু’টি কন্টেইনারবোঝাই ট্রেইলরসহ চারজনকে আটক করেন বন্দরের নিরাপত্তারক্ষীরা। বিষয়টি ইপিজেড থানা পুলিশকে জানানো হলে ওই চারজনের দেয়া তথ্যে পুলিশ বন্দরের পরিবহন ও নিরাপত্তা বিভাগে কর্মরত আরও চারজনকে আটক করে। এরপর আটক আটজনসহ মোট নয়জনের বিরুদ্ধে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ের অধীন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মারুফ হোসেন বাদী হয়ে ইপিজেড থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়।
গ্রেপ্তার হওয়া আটজনের মধ্যে চারজন বন্দরের পরিবহন ও নিরাপত্তা বিভাগে কর্মরত। তারা হলেন, পরিবহন বিভাগের নিম্নমান বহিঃসহকারী মো. আব্দুল হাকিম (৩৪), নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী কাজী আবু দাউদ (৪৮) এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা শাখায় পদায়ন হওয়া আনসার সদস্য অনুকুল বিশ্বাস (২৫) ও এনামুল হক। আর বাকি চারজন হলেন, ট্রেইলরচালক জালাল উদ্দিন (২৩), আইয়ূব আলী (২৩) ও নাজমুল হোসেন (২৭) এবং সহকারী নুরুল ইসলাম (২০)। এছাড়াও মামলায় সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকা বন্দরের নিরাপত্তা পরিচালকের দপ্তরের নিরাপত্তারক্ষী মোজাম্মেল হোসেন রবিনের (৩৭) সঙ্গে কন্টেইনার খালাসের ইক্যুইপমেন্ট পরিচালনায় নিয়োজিত অপারেটরসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। পাচারের চেষ্টা চালানো ওই দুই কন্টেইনারে কমপক্ষে ৩৫ লাখ টাকার পণ্য ছিল।
ইপিজেড থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আব্দুল করিম বলেন, পণ্যভর্তি কন্টেইনার পাচারের চেষ্টার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আটজনকে আদালতের নির্দেশে একদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আসলে এই পাচার প্রক্রিয়ার সাথে বন্দরের কর্মচারী, আনসার সদস্য, ট্রেইলর চালক ও সহকারী মিলে একটা সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করেছে। এরা কখনও ভুয়া নথিপত্র দিয়ে কন্টেইনার খালাসের অপচেষ্টাও করে। সর্বশেষ যে দু’টি পণ্যভর্তি কন্টেইনার বন্দরের ইয়ার্ড থেকে বের করে নেয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, সেগুলোর বিপরীতে বন্দরে কোনও নথিপত্রও দাখিল করা হয়নি। নিরাপত্তা ফটকে বন্দরের নিরাপত্তাকর্মী বাধা দিলে তাকে মারধর করা হয়।
নিয়মানুযায়ী, জাহাজ থেকে কন্টেইনার খালাসের পর আমদানিকারকের প্রতিনিধি কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের অংশ হিসেবে বন্দরের শুল্ক বিভাগে একটি বিল অব এন্ট্রি প্রদান করে থাকে। বন্দরের যাবতীয় ফি এবং কাস্টমস হাউজে পণ্যের জন্য নির্ধারিত শুল্ক কর পরিশোধ করার পর আমদানিকারককে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয়া হয়। খালাস প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সময় বন্দরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। খালাস শেষে দেয়া ছাড়পত্র নিরাপত্তা বিভাগে জমা দিতে হয়। নিরাপত্তা বিভাগের অনুমোদনের পর ছাড়পত্রের কপি গেটে জমা দিয়ে তবে পণ্যবাহী পরিবহনকে ইয়ার্ড থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। বন্দর সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার দিন সকাল আটটায় বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের এএসআই মারুফ হোসেন নির্ধারিত সময়ের খানিকটা দেরিতে নিরাপত্তা গেটে পৌঁছান। নিরাপত্তা গেটে গোয়েন্দা সদস্য নজরুল ইসলাম একাই ট্রেইলরগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং তাদের হামলার শিকার হন।
ওসি আব্দুল করিম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদের কয়েকজন জানিয়েছেন সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকা বন্দরের নিরাপত্তারক্ষী নথিপত্র জমা না দিয়ে ট্রেইলর চালকদের ইয়ার্ডে প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া বন্দরের কর্মচারী ও আনসার সদস্যদের যোগসাজশ আছে। যারা খালাসে জড়িত তারাও পর্যাপ্ত নথি চেক করেননি অথবা নথিপত্র ছাড়াই পণ্যভর্তি কন্টেইনার নিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন বলে আমাদের মনে হচ্ছে। ট্রেইলরেরগুলো যেসব প্রতিষ্ঠানের তাদের কারও সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, নথিপত্র দাখিল না করে বন্দরের ইয়ার্ড থেকে পণ্যভর্তি কন্টেইনার নিয়ে যাবার চেষ্টার সঙ্গে কয়েকজন কর্মচারীর সম্পৃক্ততার তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। তাদের বেশ কয়েকজন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। থানায় মামলা হয়েছে। সেটা পুলিশ তদন্ত করে আইনি পদক্ষেপ নেবে। এ ঘটনায় বন্দরের পক্ষ থেকেও পৃথক তদন্ত কমিটি করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।