কনস্টেবল হচ্ছেন গরিব ঘরের ১০৮৬ ‘ভাগ্যবান’

133

চাকরির জন্য প্রত্যেক প্রার্থীকে খরচ করতে হয়েছে ট্রেজারি চালান বাবদ মাত্র ১০০ টাকা। এছাড়াও আবেদন ফরম ফি বাবদ তিন টাকা। আর এই ১০৩ টাকাতেই চাকরি পেয়েছেন চট্টগ্রামের ১০৮৬ জন ‘ভাগ্যবান’ গরিব ঘরের সন্তান।
প্রতারকরা যাতে কোনো সুযোগ না পায় সে জন্য আগেভাগেই মাইকিং করে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। প্রচার করা হয়, ১০৩ টাকাতেই চাকরি দেয়া হবে। কথা দিয়ে কথা রেখেছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার। চট্টগ্রামের ইতিহাসে পুলিশে এমন বিরল নিয়োগ দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। এ নিয়োগে পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা বিরূপ ধারণা পাল্টে যাবে।-এমনটাই বলেছেন নিয়োগ সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা পূর্বদেশকে বলেন, আমরা দুই-তিন বছর ধরে এভাবেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আসছি। এ বছর সংখ্যাটা বেশি হয়েছে। সারাদেশের ভেতর চট্টগ্রামে এ নিয়োগ সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ১০৮৬ জনের নিয়োগ কোথাও হয়নি। এটা রুটিন কাজ। ব্যতিক্রম হলো একটাই ১০৮৬ জন নিয়োগ এটা বিরল ঘটনা। এটা ভবিষ্যতে কখনো হবে না। অতীতেও কখনো হয়নি। অতীতে সবসময় নিয়োগ হয়েছে দুইশ, তিনশ, আড়াইশ ও একশ জন।
জানা যায়, গত ১ জুলাই ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক সাত হাজার ৫১৪ প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। পরদিন শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দুই হাজার ৪২২ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়। ৬ জুলাই মৌখিক পরীক্ষা শেষে পরদিন ১০৮৬ জন প্রার্থীকে চাকরির জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়।
প্রকাশিত ফলাফলে সাধারণ কোটায় পুরুষ ৮২১ জন ও নারী ১৪৯ জন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুরুষ ৭৯ জন ও নারী পাঁচজন, পোষ্য কোটায় পুরুষ ১০ জন ও নারী দুইজন, আনসার কোটায় পুরুষ দশ জন ও নারী একজন, এতিম পুরুষ তিনজন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পুরুষ পাঁচজন ও একজন নারীকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়। অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে ১০ জন।
মনোনীতদের পারিবারিক স্বচ্ছলতা যাচাইয়ে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জরিপ চালানো হয়। জরিপে উঠে আসে নিয়োগে মনোনীতরা প্রত্যেকেই গরিব ঘরের সন্তান। এর মধ্যে কৃষকের সন্তান ৩০১ জন, গার্মেন্টস কর্মী, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রি, জেলে, কামার, হকার, শ্রমিক, নৈশপ্রহরীর সন্তান ১১২ জন, পিতৃহীন, পিতা অসুস্থ ১৬৭ জন, রিকশা, সিএনজি, ভ্যানচালকের সন্তান ৫৬ জন, দোকানদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সন্তান ১৫৯ জন, প্রবাসী শ্রমিকের সন্তান ১০৩ জন, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীর সন্তান ১০৭ জন, শিক্ষকের সন্তান ১৯ জন, চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের সন্তান ৩৩ জন, মেকানিক, গ্যারেজ কর্মী, দর্জি, নরসুন্দর, দোকানকর্মীর সন্তান ৩০ জন, পল্লী চিকিৎসকের সন্তান সাতজন ও গ্রাম পুলিশের সন্তান দুইজন।
নিয়োগের ব্যতিক্রমী দিক তুলে ধরে পুলিশ সুপার বলেন, অন্যবার আমরা প্রেস কনফারেন্স, মিডিয়াতে প্রচার এগুলো করেই নিয়োগপ্রার্থীদের সচেতন করি। এবার একবারে গ্রামাঞ্চলে মাইকিং করা হয়েছে। এতে আমাদের প্রার্থী এসেছিল ১০ থেকে ১২ হাজার। এত প্রার্থীর মধ্য থেকে যাচাইবাছাই করে ১০৮৬ জনকে নিয়োগ দিয়েছি। বাকি ১০ জনকে অপেক্ষমাণ রেখেছি। কোনো কারণে কেউ বাদ গেলে অপেক্ষমাণ থেকেই ঢুকবে। এবার জরিপ করে সকল প্রার্থীর বাবা কি করেন, পেশা কি তা নিশ্চিত হয়েছি। এরা খুব বেশি গরীব ঘরের সন্তান। খুব কষ্ট করে এরা লেখাপড়া করেছে।
এ নিয়োগ সম্পন্ন করতে কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়োগ নিয়ে একটা মহল সবসময় ধান্ধা খোঁজার চেষ্টা করেন। কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী আছেন যাদের কাজই এটা। কিছু কথিত লোক, পলিটিক্যাল এপিএস অথবা বিভিন্ন লেভেলের কিছু গ্রাম্য টাউট থাকে যারা প্রার্থীদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের ব্যাপক প্রচারণার কারণে এবং প্রার্থীদের কয়েকদফা মোটিভেশন করায় এবার সেরকম কিছু করার সুযোগ পায়নি। বহু জায়গায় এরকম ফাঁদ পাতার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। আমরা ৬-৭ জন লোককে শনাক্ত করে তাদেরকে চাকরি দেইনি।
পুলিশ সুপার বলেন, নিয়োগপ্রাপ্ত সবার বয়স ১৮-২০ বছর। ৫৯ বছর পর্যন্ত সবাই চাকরি করবে। সরকার বয়সসীমা বাড়ালে এ মেয়াদ আরো বাড়বে। ৫৯ থেকে ২০ বছর বাদ গেলে ৪০ বছর চাকরি থাকবে সবার। এরা সবাই ৪০-৪৫ বছর পুলিশে চাকরি করবেন। তাদের বলেছি, আপনারা যেভাবে নিয়োগ পেলেন জনগণ যাতে আপনাদের কাছ থেকে এমন কিছু পায়। পুলিশ নিয়ে কেউ যাতে ঢালাওভাবে নেগেটিভ কোনো কথা বলতে না পারে। ১০৮৬ জন যাতে আদর্শ পুলিশ হয় সেজন্য নির্দেশনা দিয়েছি।
নিয়োগ পাওয়া বাঁশখালী পৌরসভার বাসিন্দা বৃষ্টি দাশ পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা চাকরিটা খুব প্রয়োজন ছিল। মা নেই। বাবা একটি প্রতিষ্ঠানে প্রহরীর চাকরি করেন। আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেও আমি ও আমার ভাই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বাবার অল্প টাকা বেতনে ঘরের খরচ মিটিয়ে লেখাপড়া চালানো কঠিন ছিল। যে কারণে নিজ গ্রামে পুলিশে নিয়োগের মাইকিং শুনে চাকরির আশায় পুলিশ লাইনে গিয়েছিলাম। টাকা ছাড়া যে চাকরি হয় তা নিজের বেলায় বুঝলাম।’