কতটা প্রস্তুত টানেল?

76

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে বা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের একটি টিউব খুলে দেওয়া হবে। এছাড়া আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলের দ্বিতীয় টিউবটিও খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
গতকাল শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, টানেলের কাজ খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা গেছে। এতো বড় একটা প্রজেক্ট; নির্ধারিত সময়ে যে বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা দেশের জন্য বড় সাফল্য। টানেলটা বাংলাদেশের জন্য মডেল হিসেবে চিহ্নিত হবে।
নগরীর কর্ণফুলী নদীর নিচের বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের কাজ উদ্বোধন হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেই টানেলের কোনো কোনো অংশের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। আবার কিছু কিছু কাজ এখনো চলমান আছে। সবমিলিয়ে প্রকল্পের বাস্তব ভৌত অগ্রগতি ৮৭ শতাংশের বেশি। পাশাপাশি টানেলের উভয়প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোড ও ফ্লাইওভারের কাজও প্রায় শেষ। টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা কালাবিবিরদীঘি পর্যন্ত সুদৃশ্য অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দক্ষিণ বন্দর এলাকায় চলছে ওজন স্কেল, টোলবক্স স্থাপনের কাজ। শেষ হয়েছে দক্ষিণ বন্দর এলাকায় ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজের কাজও। টানেলের পশ্চিমে পতেঙ্গা প্রান্তে পুরোদমে এগিয়ে চলেছে সংযোগ সড়কের কাজ।
১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল টানেল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। অতিরিক্ত আরও ৬ মাস সময় দীর্ঘায়িত হলে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় হবে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। তবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলটি পুরোপুরি চালুর লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করছেন টানেল কর্তৃপক্ষ।
বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ বলেন, টানেলের উভয়প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোড ও ফ্লাইওভারের কাজ প্রায় শেষ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টানেল চালুর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ চলছে। টানেলের অভ্যন্তরে কমিউনিকেশন সিস্টেমসহ ভেন্টিলেশন ও অন্যান্য কাজের সরঞ্জাম চীনের সাংহাই লকডাউনের কারণে আনতে বিলম্ব এবং শ্লথগতিতে ছিল। প্রথম টিউবের লেনস্ল্যাব স্থাপন শেষ হয়েছে, দ্বিতীয়টির ৮০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী আমরা টানেল চালুর বিষয়ে কাজ করছি।
তিনি বলেন, সব কাজ শেষ করে চালু করা সম্ভব হবে না। কিছু কাজ বাকি থেকে যাবে। যেগুলো পরবর্তীতে করা যাবে। আমাদের প্রকল্প এলাকার বাইরে যে কাজ, সেগুলো সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ ও সড়ক জনপথ বিভাগের কাজ। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে অবহিত করা আছে, প্রত্যেক সংস্থা তার নিজস্ব কাজগুলো করবে। বাইরে কোনো কাজ বাকি থাকলে সেগুলো সংশ্লিষ্ট সংস্থা করবে।
এদিকে টানেলে নতুন করে থানা, ফায়ার সার্ভিস ও গাড়ি প্রবেশ করার আগে স্ক্যানারে পরীক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য অতিরিক্ত আরো তিন থেকে চারশ কোটি টাকা ব্যয় হবে। যদিও এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস হলেই এসব কার্যক্রমে হাত দিবে টানেল কর্তৃপক্ষ।
চারলেনের টানেল পতেঙ্গা অংশ যুক্ত হবে সাগর পাড়ের আউটার রিং রোডের সাথে। এই আউটার রিং রোড টানেলকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে যুক্ত করছে। টানেলে থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট পর্যন্ত দূরত্ব ১৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এই দূরত্বের ৬ কিলোমিটার অংশ দুই লেনের। চারলেনের টানেলের গাড়ি এই ছয় কিলোমিটার অংশে এসে দুই লেনে যাতায়ত করবে। আবার দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনিঘাট পয়েন্টে বন্দর থেকে পণ্যবাহী গাড়ি এসে যুক্ত হবে এই দুই লেনের সড়কে। এতে করে ছয় কিলোমিটার এলাকায় ভয়াবহ যানজটের শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আংশিক অংশ চালুর মাধ্যমে কিছুটা হলেও যানজট সহনীয় মাত্রায় আনার চেষ্ঠায় আছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। যদিও ডিসেম্বরের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের আংশিক অংশও চালু করা সম্ভব হবে না। দেরিতে হলেও এক্সপ্রেসওয়ের আংশিক অংশ এবং ফিডার রোড-৩ (সাগরিকা) চালু করে যানজট সহনীয় করতে চায় সিডিএ।
চীনের সাংহাই শহরের আদলে চট্টগ্রামকে ওয়ান সিটি টু টাউনে পরিণত করার কাজ চলছে। এ টানেলের কারণে শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে পর্যটকরা সরাসরি কক্সবাজার যাবেন। অন্যদিকে বিমানবন্দর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজও এগিয়ে চলছে। কর্ণফুলী টানেলে যান চলাচল শুরু হলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী যানবাহনকে আর মহানগরীতে প্রবেশ করতে হবে না। সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রæততম সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। এতে চট্টগ্রাম নগরীতে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। টানেলের কারণে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরীর সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সেতুবন্ধন তৈরি হবে। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বন্দরের কার্যক্রম প্রসারিত হবে।
মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত গড়ে উঠবে শিল্প করিডোর। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর হওয়ার পর চট্টগ্রাম হয়ে যানবাহন এই টানেল দিয়ে সহজে চলাচল করতে পারবে।
২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে নির্বাচনী সমাবেশে এ টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রæতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরই আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের) সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারই ঠিকাদার সিসিসিসিকে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে। এ বিষয়ে ২০১৪ সালের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসির মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়।