কক্সবাজারে পর্যটক ধর্ষণ ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে

109

তুষার দেব

ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যাওয়া নারী পর্যটককে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের ঘটনা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশ ভিকটিম ও তার স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে যেসব তথ্য জনপরিসরে তুলে এনেছে, তা নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। অভিযুক্তদের সাথে ধর্ষিতার ‘পূর্ব পরিচয়’ থাকার কথা সামনে এনে বর্বরোচিত এ অপরাধের ঘটনাকে ‘দুর্বল’ করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। একে সামাজিকভাবে ধর্ষিতার চরিত্র হননের চেষ্টার সাথেও তুলনা করা হয়েছে।
তবে এই অপরাধের সাথে যারাই জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে দাবি করে মামলার তদন্ত সংস্থা ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই মামলার তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। আদালতে ভিকটিমের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। তদন্তে কে কার পূর্ব পরিচিত ছিল কী ছিল না সেটা গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় নয়। মামলার অভিযোগে ধর্ষণের ঘটনার যে বিবরণ দেয়া হয়েছে আলামত ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তার সত্যাসত্য নির্ণয় করা এবং প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করাই তদন্তের মূল লক্ষ্য। পুলিশ আইনসিদ্ধভাবেই ঘটনার তদন্ত ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এখানে কারও রেহাই পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
এর আগে মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ধর্ষণের ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে রহস্যজনক মনে হয়েছে। অভিযুক্তদের সাথে ভিকটিমের পূর্ব পরিচয় ছিল। ওই নারী ঘটনার শিকার হওয়ার আরও কিছুদিন আগে থেকেই কক্সবাজারে ছিলেন। তার সন্ধানে স্বামী ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যাওয়ার পর অভিযুক্তরা বর্বরোচিত এ অপরাধ সংঘটিত করেছে বলেও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এছাড়া, মামলার প্রধান অভিযুক্ত আশিকসহ অন্যরা নানা মাধ্যমে নারীদের ফাঁদে ফেলে কক্সবাজারে নিয়ে এসে ধর্ষণ ও পাচারের মত অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারপার্সন এডভোকেট এলিনা খান গতকাল শনিবার পূর্বদেশকে বলেন, ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর যদি কোনও পক্ষ থেকে অভিযুক্তদের সাথে ভিকটিমের পূর্ব পরিচয় থাকার কথা সামনে নিয়ে আসে, তখন সামাজিকভাবে ব্যাপারটা ধর্ষিতাকে আরেক দফা ধর্ষণ করার মতই হয়ে যায়। এসব কারণে অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হলেও প্রতিকার পাওয়ার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হতে নিরুৎসাহ বোধ করেন। ধর্ষণের ক্ষত নিয়ে থানা-পুলিশ করতে গেলে তাদেরকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি ভিকটিমকে উল্টো অপবাদ দেয়ার চেষ্টা করতে আমরা দেখেছি।
তিনি বলেন, কোনও নারী ও পুরুষের মধ্যে পূর্ব পরিচয় থাকলেও ধর্ষণের ঘটনা ‘জায়েজ’ হয়ে যায় না। ঘটনার পর এ ধরনের কথা বলা ধর্ষিতাকে মানসিকভাবে নিপীড়ন ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করারই নামান্তর। এসব কথা বলে আসলে ভিকটিমের চরিত্র হনন করা হয়। পাশাপাশি শারীরিক সংসর্গের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতি থাকাকে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালানো হয়। এতে ধর্ষণের ঘটনার পাশাপাশি মামলাটিও দুর্বল হয়ে যায়।
সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, যে অভিযোগে মামলা হয়েছে তা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখাই তদন্তের অন্যতম প্রধান বিষয়। অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা আর অপরাধের সাথে যারা প্রকৃতপক্ষে জড়িত, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করাটাই একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর বাইরের বিষয়কে বড় করে দেখা বা দেখানোর চেষ্টা করা হলে আসলে প্রকৃত অপরাধই আড়ালে চলে যায়। এগুলো সুকৌশলে অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই করা হয়ে থাকে। যাতে ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়।
নারী নেত্রীদের অনেকেই বলছেন, ধর্ষণের মত বর্বরোচিত অপরাধের মামলা নিয়ে কথা বলার সময় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অধিকতর সতর্ক থাকা উচিত। তাদের কোনও বক্তব্য যাতে কোনও মতেই ধর্ষিতার জন্য সম্মানহানিকর না হয় এবং তার পরিচয় প্রকাশ না পায় সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনও কারণে মামলার গুরুত্ব কমে যেতে পারে কিংবা ঘটনাকে অন্যদিকে পরিচালিত করার মত প্রভাব পড়তে পারে- এ ধরনের বিষয়গুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন থাকতে হবে। কেউ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে থাকলে তাকেও তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা উচিত।