ওপারে থেমে থেমে ভারি গোলাবর্ষণ এপারে আতঙ্ক থমথমে পরিবেশ

18

বান্দরবান ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থেমে নেই গোলাগুলি। গতকাল শনিবার সকাল নয়টা থেকে রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং পাহাড়ে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। থেমে থেমে ছোড়া হচ্ছিল আর্টিলারি ও মর্টার শেল। আর এসব ভারি গোলাবর্ষণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছিল এপারে। গোলার বিকট শব্দে এপারের ভূমি কেঁপে উঠছে। আতঙ্কে স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে রোহিঙ্গা যুবক নিহত ও ৮ জন আহতের পর তুমব্রুতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এছাড়া গতকাল দুপুরে অবিস্ফোরিত একটি মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গ্রাম পুলিশ আবদুল জাব্বার বলেন, শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের মর্টার শেলের আঘাতে নিহত ইকবালের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ইকবালের মরদেহ গতকালই তার পরিবারের কাছে হস্তান্তরের কথা ছিল।
মর্টার শেলে হতাহতের ঘটনায় নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার পর থেকে আতঙ্কগ্রস্ত অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ বাবা-মা ও শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় তুমব্রু’র বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান। তিনি নিজেও তার বৃদ্ধ বাবা-মা ও বাড়ির শিশুদের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া শনিবার সকালে সীমান্ত এলাকায় মাইকিং করে বাসিন্দাদের নিরাপদে থাকার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
সীমান্তের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা প্রদানে শুক্রবার রাতেই ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উখিয়া কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয় এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে ৪৯৯ জন পরীক্ষার্থী গতকাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন বলে জানান নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস। তিনি বলেন, সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক ও নিরাপদে থাকার জন্য বলা হয়েছে। প্রশাসন সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
উখিয়ায় গিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থী শিফতি, রাসেল ও তাসলিমা বলেন, সীমান্তের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কেন্দ্র পরিবর্তন করে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা দিতে পারায় আমরা খ্বুই খুশি।
স্থানীয় কৃষক নুরুল ইসলাম জানান, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ বন্ধ নেই। ফলে তাদের কৃষি কাজ বন্ধ রয়েছে। সীমান্তে মাইন আতঙ্কেও ভুগছেন কৃষকরা।
স্থানীয় বাসিন্দা হাসিনা আক্তার জানান, শুক্রবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল তাদের বাড়ির উঠোনে পড়ে। এছাড়া রাতভর গুলির বিকট শব্দে বাড়ির শিশু-বৃদ্ধারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
এদিকে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে গুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ঘটনা পরিকল্পিত বলে মনে করছেন অনেকে। তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, গোলাগুলি হচ্ছে একতরফাভাবে। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে গুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ঘটনা পরিকল্পিত। কারণ, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বহু আগে থেকেই চাইছে আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের অন্যত্র (বাংলাদেশে) সরিয়ে দিতে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এই আশ্রয়শিবির ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয়। কারণ, এই শিবিরের পেছনে রাখাইন রাজ্যেই রোহিঙ্গাদের বাড়ি। বাড়ি ফিরতে হলে কিংবা বাড়ির ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হলে রোহিঙ্গারা এই আশ্রয়শিবির থেকেই হাঁটাপথে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছুক।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গির আজিজ বলেন, মিয়ানমার বাহিনী কি চায় বুঝতে পারছি না। তবে বিজিবি সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছে। তাদের টহল বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি প্রেস ক্লবের সাবেক ক্রীড়া ও পাঠাগার সম্পাদক মো. আবদুর রশিদসহ একাধিক সাংবাদিক জানান, তাদেরকে ঘুমধুম ও তুমব্রুতে দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। অথচ এখানে স্থানীয় ও বাইরের হাজারো মানুষের সমাগম রয়েছে।
তারা জানান, ঘুমধুম সীমান্তে টহলরত বিজিবি সদস্যরা তুমব্রæ বাজার, তুমব্রæ গ্রাাম, বাইশফাঁড়ি, কোনারপাড়া, মধ্যমপাড়া, হেডম্যানপাড়া, ইউনিয়ন পরিষদ ও উত্তরপাড়াসহ ঘুমধুমে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এ প্রসংঙ্গে বিজিবি সদস্যরা বলেন, তারা উপরের নির্দেশে এসব করছেন।
ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (ইনচার্জ) সোহাগ রানা বলেন, মিয়ানমার সীমান্তে কারা গোলাগুলি করছে, গোলা এসে কোথায় পড়ছে, সেখানে (সীমান্তে) গিয়ে এসব তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পুলিশের নেই। সীমান্ত এলাকায় কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে বিজিবি তৎপর রয়েছে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভেজ তিবরীজি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থানান্তর করে কক্সবাজার নেওয়া হয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, নো ম্যান্স ল্যান্ডে শুক্রবার ৩টির মতো গোলা এসে পড়ে। এসবের মধ্যে একটির বিস্ফোরণ ঘটে। যারা হতাহত হয়েছেন তারা সবাই রোহিঙ্গা।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে নতুন করে কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে এজন্য স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কোনারপাড়ায় নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাক্যাম্পে কয়েকটি মর্টার শেল পড়ে। এর একটির বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা তরুণ নিহত হন। এর আগে সীমান্তের ওপারে মাইন বিস্ফোরণে পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশি এক যুবকের। তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।