ওএমএস-এর চালের ট্রাক কখন কোথায় আসে জানা নেই ওদের

174

মনিরুল ইসলাম মুন্না

সকাল সাড়ে আটটা। নগরীর আন্দরকিল্লা পুরাতন সিটি কর্পোরেশন ভবনের সামনে নারী, পুরুষ, যুবক ও তরুণ মিলে ৩০-৪০ জনের মতো মানুষের জটলা। সকলের হাতে ব্যাগ। সামনে মূল সড়কের পাশে সারি করে রাখা হয়েছে ইট ও কাগজের টুকরা।
তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, বেশির ভাগই এসেছেন ভোরে। এদের একজন নুর নবী। বয়স ৬৫-এর কাছাকাছি। তিনি জানালেন, ফজরের নামাজ পড়েই চাল কেনার জন্য লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই প্রথম তিনি কম দামে সরকারিভাবে বিক্রি হওয়া চাল কিনতে এসেছেন।
অবশ্য নুর নবী গত মঙ্গলবার লাইনে দাঁড়ালেও চাল কিনতে পারেননি। কারণ, মানুষের এত ভিড় ছিল যে, অল্প সময়ে চাল ফুরিয়ে যায়। অনেকেই প্রতিদিন লাইনে এসে দাঁড়ালেও সবাই কিনতে পারেন না। চার-পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করে অনেকে ফিরে যান। নুর নবীসহ ৩০ জনের মতো মানুষ যেখানে সকালে অপেক্ষায় ছিলেন, সেখানে বেলা ১১টা নাগাদ মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিক। তবে একটা সময় তারা ফিরে যান চালের ট্রাকের দেখা না পেয়ে। কারণ তারা জানেন না কোথায়, কখন চালের ট্রাক আসে এবং বিক্রি হয়।
খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির আওতায় এই চাল বিক্রি করে খাদ্য অধিদপ্তর। প্রতি কেজির দাম ৩০ টাকা। সঙ্গে কিছু নির্দিষ্ট দোকানে থাকে আটাও। প্রতি কেজি ১৮ টাকা। একজন ক্রেতা এক সঙ্গে পাঁচ কেজি চাল ও দোকান থেকে চার কেজি আটা কিনতে পারেন। এতে চাল কিনতে ১৫০ টাকা এবং আটা কিনতে ৭২ টাকা ব্যয় হয়। অর্থাৎ মোট ২২২ টাকা খরচ হয় একজন ভোক্তার। বাজার থেকে কিনলে একই পরিমাণ চাল ও আটার দাম পড়ে ৫০০ টাকার বেশি।
ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খাদ্য অধিদপ্তর প্রতিবছরই কম দামে চাল ও আটা বিক্রি করে। করোনাকালের আগে খাদ্য অধিদপ্তরের ট্রাকের পেছনে কখনো ভিড় দেখা যেতো না। এমনকি ২০২০ ও ২১ সালেও মানুষের এতটা ভিড় দেখা যায়নি। কেন মাত্র পাঁচ কেজি চাল ও চার কেজি আটা কিনতে ভোরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তার কারণ জানালেন কয়েকজন। লাইনে দাঁড়ানো আয়েশা আক্তার নামে এক মহিলা জানান, তার স্বামী ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। সেই টাকা দিয়ে আর সংসার চলছে না। তারা দেড় বছর বয়সী সন্তানের মুখে ভালো খাবার তুলে দিতে পারেন না। যদি কম দামে চাল কিনতে পারেন, তাহলে কিছু টাকা সাশ্রয় হবে।
দুই বছর আগ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এক কেজি মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৩০ টাকা, যা এখন ৪৬ টাকার মতো। আর ভাল চাল তো ৫০ টাকার উপরে কেজি।
সরেজমিনে নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কেজি ৫৫ টাকার নিচে কোনো ভাল চাল নেই। প্রতি কেজি আটার দাম ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। চলতি বছরের শুরুতেও খোলা আটার কেজি ছিল ৩০ টাকার নিচে।
রিয়াজউদ্দিন বাজারের জে.কে ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মো. মামুন পূর্বদেশকে বলেন, বাজারে চাল ও আটার দাম পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আগে কখনো এমনটা হয়নি। এতে মানুষ কিনছে কম।
খাদ্য অধিদপ্তরের পরিবেশকেরা জানিয়েছেন, তাদের প্রতিজনকে দৈনিক দুই হাজার কেজি চাল দেওয়া হয়। নির্ধারিত স্পটে তা বিক্রি করা হয়। তবে কোন জায়গায় কোন দিন বিক্রি হবে, তা নির্দিষ্ট নেই।
খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম মহানগরে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ১৪টি স্থানে ট্রাকের মাধ্যমে চাল ও ১৯টি নির্দিষ্ট দোকানে আটা বিক্রি করা হয়।
এদিকে ওএমএসের ট্রাক ও পরিবেশকের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজেনর মধ্যে দরিদ্রদের সঙ্গে নিম্নবিত্তরা ছিলেন। ছিলেন মোটামুটি সচ্ছল মানুষও, যারা এখন বিপাকে পড়েছেন।
চকবাজার এলাকার আব্দুল খালেক জানালেন, তার ছেলে প্রতিমাসে ১৫ হাজার টাকার মতো আয় করে। কিন্তু সংসার সামলাতে এ টাকায় কিছুই হয় না। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম দিন দিন বাড়ছে। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে কিছুটা হলেও টাকার সাশ্রয়ের পাশাপাশি ছেলের আয়ে সহযোগিতা করছেন।
খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরে ১৪টি কেন্দ্রে ট্রাক সেলের মাধ্যমে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি ট্রাকে দুই হাজার কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর আরও ১৯টি দোকানে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। এসব দোকানে বরাদ্দ রয়েছে দেড় মেট্রিক টন চাল এবং এক টন আটা। এতে প্রতিকেজি চালের মূল্য ৩০ টাকা এবং আটার মূল্য ১৮ টাকা।
খাদ্য পরিদর্শক আবুল মনছুর মো. হাবিব পূর্বদেশকে বলেন, আমরা প্রতিদিন ট্রাক ও দোকানে বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শন করি। কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে স্থানীয় পুলিশকে খবর দিলে তারা এসে দ্রæত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এছাড়াও ডিলারের পক্ষ থেকে কর্মচারী থাকে।
চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আব্দুল কাদের পূর্বদেশকে বলেন, সাধারণ মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে চাল কিনতে পেরে স্বস্তি পাচ্ছেন। ওএমএস এর চাল বিক্রি না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম দেড় থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতেন। এখন আমাদের বিক্রি কার্যক্রম চলাতে দাম স্বাভাবিক রয়েছে।
বিক্রির পয়েন্ট আরও বাড়ানো যায় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নগরীতে ট্রাক সেল পয়েন্ট বাড়ানো উচিত। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বাইরে তো আর কিছু করা যায় না। আমরা প্রধান কার্যালয়ে জানিয়েছি, ওখান থেকে নির্দেশনা আসলে পরবর্তী পদক্ষেপে যেতে পারবো।