ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস এবং আম্রকানন কাহিনি

20

এমরান চৌধুরী

মানব বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চের পর আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো জাতীয় দিবস পালনের সুযোগ হয়নি। শুধু জাতীয় দিবস নয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানই স্বকীয় আবহে পালন করার কোনো পরিবেশ দেশে ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা যে দিবস এ প্রজন্ম বিপুল আনন্দ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উপভোগ করার কথা সেই বহুল কাক্সিক্ষত দিনদুটোও তারা উপভোগ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, আর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর মতো মহোত্তম দিবসগুলো তো আর প্রতিদিন আসবে না, আসার কথাও নয়। করোনা ভাইরাস শুধু মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি করছে তাই নয়, জীবন-জীবিকা, মানুষের হাসি-খুশি, আনন্দ-উল্লাস সবকিছুর লাগাম টেনে ধরেছে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ হাসতে ভুলে গেছে। যে পরিবার চোখের জলে ভাসার কথা ভাবনাতীত- সেই প্রাসাদোপম অট্টালিকায় এখন অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। এই ভাইরাস এতই শক্তিধর যে, এটি একটি নির্দিষ্ট জায়গার নয় নিখিল পৃথিবীর অস্তিত্বের মূলে আঘাত হেনে যাচ্ছে নিরন্তর। এ অবস্থায় নীরবে চলে যাচ্ছে, যেতে হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিন। বাঙালি জাতির স্বাধিকারের ইতিহাসে যে দিনগুলোর ভূমিকা অনন্য। তেমনি একটি দিন ছিল গত পরশু মুজিব নগর দিবস।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা -সূর্য অস্ত গিয়েছিল। বিশাল সেনাবাহিনী, গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, রণ প্রস্তুতি থাকার পরও সেদিন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দাপুটে নবাব সিরাজ উদ্দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কাছে। সেদিন যদি নবাবের আপন লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা না করত তাহলে বাংলার ইতিহাস লেখা হতো অন্যভাবে। বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার জন্য, মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়ার জন্য দুইশ চৌদ্দ বছর অপেক্ষা করতে হতো না। তাই দুটি আম্রকানন আমাদের কাছে স্মৃতি বিজড়িত-একটি সূর্যাস্তের, অন্যটি সূর্যোদয়ের।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, সেই সূর্যোদয়ের দিন। ১৭৫৭ সালে এক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। দুইশ চৌদ্দ বছর পর সেই আম্রকানন থেকে মাত্র তেইশ মাইলে দূরে আরেক আম্রকাননে উদিত হয় সেই অস্তমিত সূর্য। এ ঐতিহাসিক আম্রকাননের নাম কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা। ইতিহাস সব সময় তার গতিতেই চলে। পলাশির আম্রকাননে মীর জাফর আলী খানের নিমকহারামির দিনই ইতিহাস হয়তো লিখে রেখেছিল আরেক আম্রকাননের নাম। তা যদি না হয় সেটাতো আর কোনো কানন হতে পারত। আরও একটি বিষয় লক্ষনীয় যে দুই কাননের ব্যবধান ছিল খুব কাছাকাছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননকে নতুন নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা, সুসংহত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ১৫ দিনের মাথায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ঐদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে। এ সনদ দিয়েই বাংলাদেশ আইনগতভাবে পৃথিবীর মানচিত্র একটি নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সকাল ১১-১০ মিনিটে দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক, কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। শপথ গ্রহণের পূর্বে মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে বানানো হয় মঞ্চ। মঞ্চের উপরে পরিপাটি করে সাজানো ছয়টি চেয়ার রাখা হয়। একে একে মঞ্চে উঠে আসেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ,ক্যাপটেন এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম.কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী। মুজিবনগরে আয়োজিত এ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান।পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, গীতা ও পবিত্র বাইবেল পাঠের পর স্থানীয় শিল্পী ও হাজার হাজার মানুষের প্রাণময় কন্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করেন জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউছুফ আলী। এরপর তিনি নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মন্ত্রীবর্গকে শপথ বাক্য গঠন করেন। এটি ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে সমধিক পরিচিত।
মুজিবনগর সরকারের কাঠামো ছিল নিম্নরূপঃ
রাষ্ট্রপতিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
উপ-রাষ্ট্রপতি-সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকারবলে সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক)
প্রধানমন্ত্রী ঃ তাজউদ্দীন আহমদ
অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীঃ এম. মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীঃ এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান
পররাষ্ট্র, সংসদ ও আইনমন্ত্রীঃ খন্দকার মোশতাক আহমদ
প্রধান সেনাপতিঃ কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী
চিফ অব স্টাফঃ কর্নেল (অব) আবদুর রব
ডেপুটি চীফ অব স্টাফঃ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে.খন্দকার।
এ সরকার গঠনের মাত্র দুই ঘণ্টা পর পাকিস্তান বাহিনী মুজিবনগরের উপর বোমাবর্ষণ করে এলাকাটি দখল করে নেয়। তাই বাধ্য হয়ে মুজিব নগর প্রশাসনকে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে সরিয়ে নিতে হয়। কিন্তু অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষিত মুজিবনগর নামের আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। নবগঠিত অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে এই মুজিবনগর নামই ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত পরিচিত ছিল সাড়ে কোটি বাঙালি আর বিশ্ববাসীর কাছে।
নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গুরু দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার পর জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সেদিন উপস্থিত জাতীয় পরিষদ সদস্য, সুধী, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন । নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বীকৃতিদান ও এর সাহায্য ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য তিনি বিশ্বের জাতিবর্গের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোনো জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না।’
বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী আবেগদীপ্ত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘দরকার হলে আমরা বিশ বছর ধরে লড়াই করব। হতে পারে এ যুগের ছেলেরা লড়াই করে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু পরের যুগের ছেলেরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে।’
আমাদের জাতীয় জীবনে তাই মুজিব নগর দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। কারণ এই দিনই শুরু হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। বিশ্ববাসী জেনেছিল একটি দেশের মানুষ কীভাবে স্বাধীনতা লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। অসম যুদ্ধে শুধুমাত্র স্বাধীনতার স্পৃহা, অসীম মনোবল আর বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠকে হাতিয়ার করে কীভাবে জয়বাংলা বলে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে তারই প্রোজ্জ্বল দিন ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক