এ কেমন ভালোবাসা

82

প্রত্যেক জীবের জন্মের সাথে সাথে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। মানুষে মানুষে ভালোবাসা, এমনকি মানুষ পশু-পাখিকেও ভালবাসে। যে নিজেকে ভালবাসতে জানে, সে অন্যকে ভালবাসতে শেখে। নিজেকে ভালোবাসা সহজ, অন্যকে ভালোবাসা কঠিন। নিজের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়না, অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ নিজেকে গভীরভাবে ভালবাসে, এক্ষেত্রে নিজের প্রতি ভালোবাসা শতভাগ এবং অন্যের বেলায় ক্ষেত্র বিশেষে তা কম-বেশি হতে পারে। কেননা, নিজের জীবন অন্য জীবনের চেয়ে দামি।
“এ কেমন ভালোবাসা” নিয়ে আলোকপাত করার আগে মানুষ নিজেকে অত্যাধিক ভালবাসে, এ বিষয়ে দুই একটি ঘটনার অবতারনা করতে চাই। বেশ কয়েক বছর আগের কথা, ঢাকা-বরিশাল রুটে একটি লঞ্চ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে মেঘনা নদীতে ডুবে যায়। ওই লঞ্চে অনেক যাত্রীর মধ্যে আব্দুল ছালাম নামে এক যাত্রীর সাথে স্ত্রী এবং বাবা ছিল, সে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য মরণপণ সাঁতার কেটেঁ নদীর কূলে উঠতে সক্ষম হয়। তার বক্তব্য মতে, নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে তাদের কথা ভুলে গিয়েছিল। তার স্ত্রী ও বাবা অন্যদের সাথে ¯স্রোতে ভেসে পরপারে চলে যায়। এহেন অমানবিক কাজটি করার পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছিল, সে নিজেকে খুব ভালবাসে।
গুম, খুনের ভয়ে জীবনের হুমকিতে থাকা মানুষগুলো জীবণ বাঁচানোর জন্য বিলাসবহুল বাড়ির মায়া ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় গ্রামে অথবা কোন এক নিঝুম দ্বীপে। কেননা, অর্থ-বিত্তকে সে নিজের জীবনের চেয়ে তুচ্ছ মনে করে। অর্থাৎ তারা নিজেদের অধিক ভালবাসে।
আগেকার দিনে রাজা -বাদশাহগণ নিজের জীবন বাঁচাতে গিয়ে প্রয়োজনে সিংহাসন ত্যাগ করেছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে সিংহাসনের চেয়ে নিজের জীবন অনেক মূল্যবান। নিজের জীবনের প্রতি অকুন্ঠ ভালোবাসার কারণে তাঁরা সিংহাসন ছাড়ার মত কঠিন কাজটি সহজভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন।
সম্প্রতি কয়েকটি হৃদয় বিদারক এবং মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ডের মামলা রায় হয়েছে, তন্মধ্যে গুলশান হোলি আর্টিজান বেকারী হামলা ও হত্যাযজ্ঞ, নুসরাত হাজান রাফি হত্যা, গাইবান্ধার সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ২০১৬ সালের ০১ জুলাই গুলশান হোলি আর্টিজান বেকারীতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় এবং নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ১৭ জন বিদেশিসহ মোট ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২৯ নভেম্বর ২০১৯ ইং তারিখে সেই মামলার রায়ে সাত আসামির মৃত্যদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়। জঙ্গিদের ঔদ্বত্যে আদালতে উপস্থিত সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেন। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর জঙ্গিরা সমস্বরে শ্লোগান ও চিৎকার করতে থাকে। তারা নিজেদের আই এস পরিচয় দিতে উৎসাহ বোধ করে এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে তথাকথিত শহীদের মর্যাদা পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে চিৎকার করছে। এ দৃশ্য যারা দেখেছে, সবাই হতবাক হয়েছে।
কিছুদিন আগে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতের বর্বরোচিত হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়। ওই মামলায় অভিযুক্ত ১৬ আসামিকে আদালত মৃত্যুদন্ড দেয়। আসামিগণ আদালতে যাওয়া-আসার প্রাক্কালে বিভিন্ন ধরনের আষ্ফালন, কটুক্তি ও দাম্ভিকতা প্রকাশ করে। বলাবাহুল্য, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌল্লার লোভ-লালসার শিকার নুসরাত জাহান রাফি। কয়েক দিন আগে গাইবান্ধা-১ সুন্দরগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার ও রায়ে সাবেক সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) ডা. আাব্দুল কাদের খান সহ সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, আসামিরা ঘরে ঢুকে ফিল্মি স্টাইলে লিটন সাহেবকে খুন করে। মামলার রায়ে রাজনৈতিক কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার ও এম পি হওয়ার লোভ মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। মূল আসামি আব্দুল কাদের খানকে পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় হাসতে দেখা যায়।
এ হত্যাকাণ্ডগুলো আলাদাভাবে সংঘটিত হলেও আসামিদের আলাদা করে ভাবার সুযোগ নেই। সবাই আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে এবং নিজেদের জীবনের প্রতি চরম উদাসীনতা প্রকাশ পায়। হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানোর সময় অভিযুক্তদের মাথায় যে হিংস্রতা ও উন্মত্ততা কাজ করেছিল, রায় হওয়ার পরেও একই ধরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাদের কাছ থেকে পরিলক্ষিত হয়। একথা স্পষ্ট হয়েছে, কোন অপরাধবোধ তাদেরকে এতটুকু বিচলিত করেনি। তাদের ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত, একথাও তাদের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছেনা। নিজেদের জীবন বিপন্ন হবে এবং সাথে প্রত্যেক পরিবারে পারিবারিক জীবন বিনষ্ট হবে, সেই ভয়-ভীতিও তাদের মধ্যে কাজ করছেনা। তাদের অন্ধবিশ্বাস, তারা ছিল, আছে এবং থাকবে। এই সমাজে অত্যাচারীর খড়গ হাতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে। একজন নুসরাতকে হত্যা করতে গিয়ে ১৬ জন আসামির প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততা এবং একজন লিটনকে খুন করতে গিয়ে সাত আসামি জড়িত থাকার বিষয় সত্যিই উদ্বেগের কারণ।
বর্তমান সমাজে মানুষ অনেক সচেতন। নিজেদের প্রতি অধিক যত্নবান। চলার পথে সবসময় সতর্ক থাকার কথা চিন্তা করে। অন্যায়-অনৈতিক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। নিজের জীবন যেন কোন কারণে ঝুঁকিপূর্ণ না হয়, তাই নিয়ে সবসময় ভয়-ভীতি ও চিন্তাযুক্ত থাকে। আসুন, আমরা নিজেদের নিরাপদ রাখি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের নিরাপদ রাখতে সহায়তা করি।
লেখক : কলামিস্ট