এসিড নিক্ষেপকারীর যাবজ্জীবন

8

নিজস্ব প্রতিবেদক

৬ বছর ধরে সীমাহীন যন্ত্রণার সাগর পাড়ি দিতে দিতে ক্লান্ত তমাল। এসিডে ঝলসে দেয়া হয়েছিল তার পুরো মুখোমন্ডল। চোখ দু’টো এসিড নিক্ষেপের পরপরই শেষ হয়ে যায়। তবুও অপেক্ষায় ছিল একদিন এসিড সন্ত্রাসীদের বিচার হবে। বিচার হলো ঠিকই। কিন্তু তমাল সেই বিচারে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সন্তুষ্ট হতে পারেননি তার মা বাবা; যারা ছেলেকে এসিড মারার ঘটনায় দায়ীদের বিচার চাইতে গিয়েই বর্তমানে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন। তাদের যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় নিজেরই ফাঁসি চাইলেন ঝলসে যাওয়া তমাল।
এসিড মেরে তরুণ তমালের দুই চোখসহ মুখমন্ডল ঝলসে দেওয়ার মামলায় অভিযুক্ত দম্পতির মধ্যে স্বামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। তবে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় স্ত্রীকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। দু’জনই পলাতক রয়েছেন।
গতকাল রবিবার চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া এ রায় দিয়েছেন। দন্ডিত আসামির নাম সুমিত ধর (৩০)। বেকসুর খালাস পাওয়া আসামি হচ্ছেন মৌমিতা দত্ত (২৬)। সুমিত কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং গ্রামের দেবব্রত ধরের ছেলে।
এসিড নিক্ষেপের শিকার তমাল চন্দ্র দে (৩০) চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র দে’র ছেলে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলী অতিরিক্ত মহানগর পিপি নোমান চৌধুরী জানিয়েছেন, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫ ধারায় সুমিতকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে এক বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। মামলায় দন্ডিত আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতের সামনে আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এ কারনে আদালতের বিচারক উল্লেখিত আসামিকে দন্ডাদেশ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নগরীর কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জে গুডস হিলের পাশে তমাল এসিড নিক্ষেপের শিকার হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তার বাবা বাদী হয়ে মৌমিতা-সুমিত এবং অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করা মৌমিতা ও সুমিত পরিবারের অজ্ঞাতে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বিয়ে করে আলাদাভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। স্নাতক পাস তমাল ছিলেন মৌমিতার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সেই সুবাদে বিয়ের কিছুদিন পর মৌমিতা আবার গোপনে তমালের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এক বছর পর তমাল মৌমিতার সঙ্গে সুমিতের সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর মৌমিতাকে একটি রেস্টুরেন্টে ডেকে নিয়ে যান তমাল। সেখানে মৌমিতা সুমিতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি স্বীকার করে এবং তাদের কোর্ট ম্যারেজ হয়েছে বলেও জানায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মৌমিতাকে চড় মারেন তমাল। এ ঘটনার মাসখানেক পর ‘প্রজাপতির ডানা’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ পান তমাল। নিয়মিত কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাকে ওই আইডি থেকে তমালকে দেখা করার অনুরোধ করা হয়। সাক্ষাতের জন্য গেলে সুমিত তার মুখে এসিড ছুড়ে মারে। এসিডে আক্রান্ত হয়ে তমালের দুই চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া তার মুখমন্ডলও বিকৃত হয়ে গেছে। এই অবস্থায় সুমিত ও মৌমিতা গ্রেপ্তার এড়াতে ঢাকা চলে যান। সেখানে মৌমিতা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সুমিত কয়েকটি টিউশন নেন। এভাবেই তাদের সংসার চলছিল। ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর ভাটারা থানার ভাড়া বাসা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় দায় স্বীকার করে সুমিত আদালতে জবানবন্দি দেন। তবে একবছর পর জামিনে বেরিয়ে দু’জনই পালিয়ে যান। দু’জন ভারতে পালিয়ে গেছেন উল্লেখ করে তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি দেন বাদী বাবুল কান্তি দে।
তথ্যমতে, অভিযোগপত্র আদালতে দাখিলের পর ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২৪ জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত মহানগর পিপি নোমান চৌধুরী জানান, ‘বিবাহিত হওয়ার পরও মৌমিতা তমালের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। আবার বিবাহিত জানার পর তমালও সরে না এসে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। বিষয়টি শুনে সুমিত, তমালের ওপর ক্ষুব্ধ হয় এবং তাকে এসিড ছুড়ে মারে। বিষয়টি আদালতে প্রমাণ হয়েছে এবং সুমিতের যাবজ্জীবন কারাদÐ হয়েছে। একটি ফেসবুক আইডি থেকে যোগাযোগ করে তমালকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছে, সেই আইডি ছিল মৌমিতার। কিন্তু সেটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ না হওয়ায় আসামি খালাস পেয়েছেন’।
এদিকে রায় ঘোষণার পর আদালতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান তমাল ও তার বাবা-মা। তমাল এসময় বলতে থাকেন, ‘এসিড নিক্ষেপের সাজা মৃত্যুদন্ড। যাবজ্জীবন কেন দেওয়া হলো? আদালতকে বলুন, আমাকে ফাঁসি দিয়ে দিতে। আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুক’। আমিতো এমনিতেই মরে গেছি।