এসডিজি অর্জনে প্রয়োজন শিক্ষাই জাতীয়করণ

141

-ঝউএং এর পূর্ণরূপ হলো ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নামে পরিচিত। সাধারণ অর্থে এসডিজি হলো ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একগুচ্ছ লক্ষ্যমাত্রা। জাতিসংঘ এই উদ্দেশ্যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করেছে এবং আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের প্রায় সকল দেশ জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ঐক্যমতে পৌঁছেছে। এই এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন বলতে ঐ ধরণের উন্নয়নমূলক কর্মকাÐকে বোঝায় যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও নিশ্চিত হয়, কিন্তু প্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমেও কোনো বাজে প্রভাব পড়বে না। জাতিসংঘ ঘোষিত এ ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা হলো- ১. দারিদ্র বিমোচন, ২. ক্ষুধা মুক্তি, ৩. সুস্বাস্থ্য, ৪. মানসম্মত শিক্ষা, ৫. জেন্ডার সমতা, ৬. বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, ৭. ব্যয়সাধ্য ও টেকসই জ্বালানী, ৮. সবার জন্য ভালো কর্মসংস্থান, ৯. উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো, ১০. বৈষম্য হ্রাসকরণ, ১১. টেকসই শহর ও সম্প্রদায়, ১২. (সম্পদের) দায়িত্বশীল ব্যবহার, ১৩. জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ, ১৪. সমুদ্রের সুরক্ষা, ১৫. ভূমির সুরক্ষা, ১৬. শান্তি ও ন্যায় বিচার, ১৭. লক্ষ্য অর্জনের জন্য অংশীদারিত্ব। এই ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এসডিজি ৪ হলো মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি এর গুণগত মান নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্ব বহন করে। বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি দু’ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক শিক্ষা চালু রয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা ব্যয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। যেখানে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬ষ্ঠ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন ১০ থেকে ১২ টাকা মাত্র, সেখানে একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন ১৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ শহর কেন্দ্রিক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে সরকারি কর্মকর্তা, সমাজের ধনিক ও সম্পদশালী শ্রেণির মানুষের সন্তানরা। অন্যদিকে যেহেতু গ্রামাঞ্চলে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিতান্তই অপ্রতুল সেক্ষেত্রে অধিকাংশ অসচ্ছল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা অধিক খরচে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে বাধ্য হচ্ছে। এক্ষেত্রে একজন অভিভাবকের পক্ষে পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্বাহের পর দুই বা তিনজন সন্তানের শিক্ষা ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেসরকারি শিক্ষার ব্যয় এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা অধিক হারে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে দেশের বিশাল অংকের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা বঞ্চিত রেখে ২০৩০ নাগাদ এসডিজি অর্জনের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৪র্থ লক্ষ্যমাত্রা সব নাগরিকদের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চিতকরণ আমরা অর্জন করতে পারব কিনা তা প্রশ্ন থেকে যায়। এর ফলশ্রæতিতে বাস্তবে আমরা দেখি অনেক অভিভাবক সন্তানের লেখাপড়ার মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহে অসমর্থ হওয়ায় তাদের সন্তানগুলো অকালে ঝরে পড়ে অলস জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। আবার অন্যদিকে অলস মস্তিস্ক হলো শয়তানের কারখানা। শেষ পর্যন্ত এসমস্ত শিক্ষার্থীরাই দিকভ্রষ্ট হয়ে সমাজের নানারকম অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে বিশাল অংকের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা বঞ্চিত রেখে আমাদের জাতীয় উন্নয়নও সম্ভব নয়। তাই একমাত্র মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে ঐ সমস্ত ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূলধারায় ফিরিয়ে এনে স্বল্প খরচে সবার শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করে শিক্ষার প্রসারকে গতিশীল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
আবার অন্যদিকে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত ছাড়া এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সম্ভব নয়। শিক্ষার এই গুণগত মান নিশ্চিত করার নিপুণ কারিগর হলেন আমাদের শিক্ষক সমাজ। যেহেতু দেশের ৯৫% শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন করে কিন্তু সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় নিতান্তই কম বিধায় মেধাবীরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় অনাগ্রহ দেখাচ্ছে যেটি শিক্ষার গুণগত মান রক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাঠক্রম এবং পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও এক এবং সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এক হওয়ায় সত্তে¡ও সমান কাজ করেও আর্থিক সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষকরা পিছিয়ে আছে বলে মেধাবীরা এই পেশা গ্রহণ করতে অনীহা দেখাচ্ছে, যা আমাদের দেশের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভাজন থাকা মানে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়া। তাই দেশের উন্নয়নকে তরান্বিত করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় সমতায়ন জরুরি। যদিও ইতিমধ্যেই বর্তমান সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নের প্রতি লক্ষ্য রেখে ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ও ২০% বৈশাখী ভাতা চালু করেছেন যা প্রশংসার দাবি রাখে। জাতীয় পে-স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা ও শিক্ষা ভাতা সহ পেনশন ভাতা চালু এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় আছে।
স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে অসাম্প্রদায়িকতার মূল্যবোধের ভিত্তিতে মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ সহ শিক্ষকদের অধিকার সুরক্ষা করতে পারলেই এসডিজি অর্জনের ৪র্থ লক্ষ্যমাত্রা শিক্ষার গুণগত মান অর্জনের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে এর প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। আমি আশা রাখি দেশের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ ব্যবস্থার বাস্তব সম্মত প্রদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশকে ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপায়নের মাধ্যমে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এদেশকে সমৃদ্ধ করবে। আশা করি, সরকারের এসব দূরদর্শি উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমতা ভিত্তিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ও জীবনব্যাপী শিখনের লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করে জাতির জনকের অসমাপ্ত যে স্বপ্ন সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা তা বাস্তবে রূপ লাভ করে বিশ্বের দরবারে এদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমি সেই প্রত্যাশায় রইলাম।