এমরান চৌধুরী’র কিশোরগল্প গ্রন্থ : ফেল করা ছেলেটি

84

নূর নাহার নিপা

খ্যাতিমান ছড়াকার এমরান চৌধুরি। সাহিত্যাঙ্গনে এক বিশিষ্ট মুখ, সভ্যসাচী লেখক। তিনি ছড়া,কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস প্রভৃতি শাখাতে তিনি একজন দক্ষসাহিত্যিক। নির্ভুতে কাব্যচর্চা দিয়ে শুরু হলে ও আশি দশকের শেষ ভাগে পত্রিকায় ছড়া লেখে আত্মপ্রকাশ সাহিত্য জগতে। দেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব কাগজে বিরামহীন লিখে চলেছেন ছড়া,প্রবন্ধ, গল্প, ছোটদের বড়দের, সময়ের সচল জনপ্রিয় লেখক। ২০২২ বইমেলায় প্রকাশ করেন।ফেল করা ছেলেটি -এই গল্প গ্রন্থটি তাঁর সৃষ্টি গল্প গুলোর মধ্যে অন্যতম পাঠে তৃপ্ততা অনুভব করলাম।
ছোটদের জন্য লেখা গল্প গুলোতে এনেছেন বিপুল বিষয় বৈচিত্র্য। তাঁর প্রতিটি গল্পতে বাস্তবতা সামাজিকতা, মানবতা, দায়িত্বতা, মানুষ ও প্রকৃতির, আবেগ কল্পনা, অপূর্ব শব্দশিল্প গল্পগুলো ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন। কিশোর গল্পগ্রন্থটি ৮ টি গল্প প্রকাশিত।প্রতিটি গল্প আধুনিকতার ছোঁয়া নান্দনিক। অপূর্ব বিষয়, ভাব, কল্পনায়,শব্দ শৈলি উপমা নৈপুণ্য অসামান্য প্রশংসিংত কিশোর গল্পগুলো যেমন-দাদুর মুখে চাঁদের হাসি,বাবা বাসায় নেই,সালাম,রাজপথের রাজা,মানুষ, ভিটামিন স্যার,গুন্ডুইলা, ফেল করা ছেলেটি বিভিন্ন গল্পগুলোতে অসাধারণভাবে উপমাগুলো রচিত যেমন-
ফেল করা ছেলেটি-জীবনে কেউ ফেল না করলে সাকসেস হয় না। আর এই ছেলেটা ফেল করেছে বলেই আপনারা চিনলেন,ছেলেটা কত মেধাবী।
এই ক্লাসে আরও একান্ন জন শিক্ষার্থী আছে সবার প্রগ্রেসিভ রিপোট আমি শিক্ষা অফিসে দেখেছি।মাত্র আড়াই নম্বর বেশি পেলে ছেলেটা হতো ফাস্টবয়।আপনারা অংক, ইংরেজি,বিগান,এসব বিষয়ে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা নেননি। যা নেওয়া উচিত ছিল।ভবিষ্যতে এ দিকটার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন।বলেই পরিদশর্ক আর কোনো ক্লাসে না গিয়ে সোজা গিয়ে উঠলেন তাঁকে বহন গাড়িতে।আর এদিকে ক্লাস ফাইভের ছেলেরা ফেল করা ছেলেটিকে কাঁধে নিয়ে মাঠের এ মাথা থেকে ও মাথা মাথায় তুলে নাচতে লাগল।
বাবা বাসায় নেই- মজার একটি গল্প বাবা ফোনটি রিসিভ করে বললেন,মোবারক সাহেব আমি বাসায় নেই।এ কথা শুনে অবাক হলো ছেলে বাবা বাসায় অথচ বলেন বাসায় নেই। এ কেমন কথা। বুকের ভেতর বুদবুদ উঠতে ওর। তৃতীয়বার রিং টোন বেজে ওঠে।ছেলে ভাবে কারো জরুরি ফোন হবে। তাই সে ফোনটা রিসিভ করল।ও পার থেকে তার বাবাকে লোকটি চাইল।তখন সে ভাবল,বাবা বাসায় নেই বলাটা ঠিক হবে।কারণ সকালে তিনি তাই ততো বললেন।ছেলে ও তাই করল।বাবা বলে কার ফোন রে
তুমি কী বললে? বললাম বাবা বাসায় নেই।কী বললে তুমি এইটা বলতে গেলে কেন? আপনি যে সকালে বললেন।বাবা -আমি সকালে বলছি লোকটা আমার কাছে টাকা পাওনা।আর এখন যে লোকটা ফোন করেছে উনার কাছে আমি অনেক টাকা পাওনা আছি। ছেলে ফোনে টাকা আসে তাতো আমি জানতাম না। ছেলের কানে তখন ও অনুরণিত হচ্ছিল মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।বাবা ও বুঝতে পারলেন মিছে কথা বলার ফল এমই হয়। এই গল্পে চমৎকার একটি বাস্তবতা খুঁজে পেলাম। শিশুরা মিথ্যা বলে না, কে শেখায় তাদের মিথ্যা?
সালাম-সালাম বড়রা আগে দেবে,না ছোটরা?
আমরা মুসলিম একজন অপরজনের সাথে দেখা হলে আমরা সালাম বিনিময় করি।সালাম যে কেউ আগে দিতে পারে। তিনি বয়সে ছোট হোক বড় হোক। যে প্রথমে সালাম দেবে তার সম্মান বাড়ে,সালাম দিলে আল্লাহ খুশি হন।তাই এখন আমরা সবাই সালাম দিবো।কত সহজে গল্পকার সহজভাবে সালামের প্রশংসা ছোটদের, বড়দের, গল্পের মাঝে মিষ্টি ভাষায় ফুটে তুলেছেন সনিষ্ট আন্তরিকতায়। গল্পটি সমসাময়িক বাস্তবতা সমাজের ভাবনায় সমৃদ্ধ।
ভিটামিন স্যার-ছাত্রছাত্রীদের সবার কাছে তিনি ভিটামিন স্যার নামে সুপরিচিত। স্যার প্রধানত বাংলার শিক্ষক। তবে তিনি নির্দিষ্ট পাঠে থাকার মানুষ নন। পাশাপাশি চলে যান বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাসেও। কলন্বাস কীভাবে আমিরিকা আবিষ্কার করেছিল। পানিপথের যুদ্ধ কি পানির ওপর হয়েছিল? তেমনি পৃথিবীটা কীরকম গোল? ডিমের মতো না আলোর মতো! নাকি কমলালেবুর মতো।এসব তিনি বেশ মজা করে বুঝিয়ে দেন ছাত্রদের। সেদিন তিনি পড়ার ফাঁকে চলে যান ভিটামিনে। ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়েছো? ছাত্রছাত্রী পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করল। স্যার যেন মঙ্গলগ্রহ থেকে আগন্তুক কেউ। কম বেশি সবার মুখে ভিটামিন এ ক্যাপসুলের ফোঁটা পড়েছে। রোজই ভিটামিন খাচ্ছি কিন্তু কোন ভিটামিন খুবই জরুরি সেটা ও জানা প্রয়োজন। স্যার দু “ধরনের ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। ৬ মাস থেকে ১১ মাসের নীল রংয়ের ক্যাপসুল, আর ১২ থেকে ৫৯ মাসের শিশুদের লাল রংয়ের ক্যাপসুল। নওরিন বিষয়টি পড়েছে।তাই বলতে পারল তবে রাতের বেলা কথাটা মনের ভেতরে উঠানামা করছে।ঠিক এই শব্দটি তাদের মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ল। স্যার- রাতের বেলা বা অল্প আলোতে যারা কম দেখে। কোনো জিনিস খুঁজতে গিয়ে যে জায়গা আছে সেখানে না খুঁজে অন্য জায়গা খুঁজে।হাঁটতে গেয়ে হোঁচট খায়। এই হলো রাতকানা সবাই বুঝতে পেরেছ। রাতকানার জন্য টিকা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।সেখানে যে স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা দেন তাঁরা এ ব্যাপারে পরামর্শ দেবেন।কারও রাতকানা হলে এ কাজটি করতে হবে। সময়মতো যদি রাতকানার চিকিৎসা না হয় তাহলে শিশুটি অন্ধ হয়ে যেতে পারে।তাহলে বুঝতে পারলে সরকার কেন প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ায়। ছোটদের, বড়দের, সকলের চোখ বাঁচাতে, চোখের আলো ফকফকা রাখতে কচু শাক খেতে হবে? কচু শাক হচ্ছে ভিটামিন এ এর রাজা।অসাধারণ বাস্তবতা গল্পটিকে নিখুঁতভাবে লেখেছেন মনের সৌন্দর্য দিয়ে। অনন্য সৃষ্টিকর্ম হিসাবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে।
রাজপথের রাজা-দেশের এখন এক ভয়ংকর অসুখ।যে অসুখের কোনো দাওয়াই নেই।বাঁচতে চাইলে শুধু ঘরে থাকা কী জানি কয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।বাসা বাড়িতে ঢুকার পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া।কিন্তু কজন পারবে এ নিয়ম মানতে।তবে এ অসুখ শুধু আমাদের দেশে নয়।আজ নিজেরাই সামান্য ভাইরাসের কাছে কুপোকাত।অথচ এই ভাইরাস নাকি বালুকতার চেয়ে ও হাজার গুণ ছোট। আল্লাহ একখান খেল দেখাচ্ছে। সবার মুখে মাস্ক জরুরি নিদের্শন বেরোলেই মাস্ক পরে বেরোব।সাধারণ অসাধারণ বস্তির সব্বাই মাস্ক পইরা বাইর অয়।
এতক্ষণ যাদের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে এই ছেলেটা একদম আলাদা।ছেলেটার জামাকাপড় বেশ পরিচ্ছন্ন।আর মুখে মাস্ক।অন্য ছেলেদের কার ও মুখে মাস্ক নেই।আর জামাগুলোও ছিল ময়লায় ভরা।
কী নাম তোমার,খোকা? রাজা।
রাজা নামটা শুনেই তাঁদের মনে শিশুটিকে নিয়ে কৌতুহল জাগে। তো রাজা সাহেব,তুমি বড় হলে কী হতে চাও? আদরের সুরে জানতে চাইলেন তাঁরা।ফিক করে হেসে দিলো রাজা।বলল,আমি বড় হলে আমনের মতো হতে চাই।কেন?
আমনে ভালা মানুষ। ভালা মানুষেরা ছোটদের ভালোবাসে।খাওন দেয়।বলেই রাজপথের রাজার মুখে ফুটে ওঠল কোটি টাকার হাসি।সে হাসিতে আকাশের মালিক ও যেন হেসে ওঠল।
এই গল্পটিতে ত্যাগের আনন্দের চিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
এমরান চৌধুরীর জন্ম ১৮ ফেব্রæয়ারি, চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব কেশুয়া গ্রামে। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সদালাপী, ভদ্র ও সজ্জন ব্যক্তি,তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে লেখালেখির সাথে নিবেদিত হয়ে। বর্তমানে তিনি জনপ্রিয় সংকলন শিশুকিশোর পাতা আলোর পাতার সম্পাদনা করেন। বিশিষ্টজনেরা তাঁকে প্রকৃত একজন সভ্যসাচি লেখক হিসাবে জানেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ ছড়াকবিতা-২৮ টি তার মধ্য যেমন-থির দুপুরে বিজন পথে,স্বাধীনতা মানে পাখিরাই জানে,আমার আছে তিনটা মামা,খোকার বাড়ি অনেক দূর,সমকালীন ছড়া,ঋতুর খেলা ছড়ার মেলা,মুজিব এখন সবার বুকে।
গল্প- চিকন খোলার ভূত,মুক্তিযুদ্ধার একদিন,গল্পগুলো মজার,টুকটুকি ও টুকটুকি,একাত্তরের গল্প শোনো,গল্পে গল্পে মহানবী (সা:)।
প্রবন্ধ -ফাদার অব দ্যা নেশন, ভাষা আন্দোলনের কিশোর ইতিহাস,বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম।জীবনী. যুগের প্রতীক মওলানা মনিরুজ্জমান এছলামাবাদী,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,ছোটদের বঙ্গবন্ধু , ছোটদের বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীর পিতা,বঙ্গবন্ধু কে নিবেদিত ছড়াকবিতা, ছড়া কবিতায় একুশ।
সম্মাননা স্মারক-বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি পদক ২০১৮, কিউস কালচারাল ইন্সটিটিউট সম্মাননা ২০১৭.কথন শিশুসাহিত্য পুরষ্কার ২০০৯, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরি সাহিত্য পুরস্কার ১৯৯০,২০২২ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরস্কার। বাংলা সাহিত্যেকে সমৃদ্ধি করে চলেছেন তাঁর মূল্যাবান সৃষ্টি দিয়ে। তাঁর গল্পগুলো পড়ে সত্যই আপ্লুত হলাম। অসাধারণ কিছু গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে কিশোরগল্প গ্রন্থটি। তিনি সাহিত্যের জন্য ২০২২ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পুরস্কার পেলেন।কবির এই প্রাপ্তিতে আমরা ভীষণ আনন্দিত। এই পুরস্কার কবিকে আরো আলোকিত সমৃদ্ধি করবে সাহিত্যজগত আরো ও দৃঢ় হোক, কবির কলম চলতে থাকুক সমসাময়িক ভাবনাগুলো নিয়ে
আপনার লেখালেখির জীবন আরও সমৃদ্ধ হোক,আমাদের সাহিত্য আর ও উজ্জ্বল হোক,
আপনি সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন,সুন্দর থাকুন,
আমাদের প্রত্যাশা।